কোরআনের কিছু আয়াত এর অন্য কিছু আয়াতকে রদ (নাসখ) করেছে – এরকম একটা তত্ব বা মতবাদ চালু আছে মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যেও। চূড়ান্তভাবে বিতর্কিত ও ভিত্তিহীন এই ধারণা কোরআনের বিরুদ্ধে প্রচারিত বিপদজনক মিথ্যাগুলির অন্যতম। কোরআনের কিছু আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা ও হাদিসসহ বিভিন্ন সেকেন্ডারি সোর্স এই মিথ্যাগুলির উত্স। এ প্রচারণা মূলত কোরআনকে ঐশ্বরিক গ্রন্থের মর্যাদা থেকে নামিয়ে মানব রচিত এক গ্রন্থের পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা- যা নবীর সমসাময়িক আরবরাও করেছিল। পরবর্তীতে অনেক পন্ডিতও হাদিসের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে এই তত্বে সমর্থন যুগিয়ে গেছেন।
সাধারণত কোরআনের ২টি আয়াতকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে রহিত আয়াতের তত্বটিকে জায়েজ করার চেষ্টা হয়ে থাকে।
২:১০৬ আমি কোন আয়াত রহিত করলে অথবা বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন করি।
১৬:১০১ এবং যখন আমি এক আয়াতের স্থলে অন্য আয়াত উপস্থিত করি এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন তিনিই সে সম্পর্কে ভাল জানেন; তখন তারা বলে, আপনি তো মনগড়া উক্তি করেন বরং তাদের অধিকাংশ লোকই জানেনা।
এখানে আয়াত বলতে কোরআনের আয়াত বা বাক্যকে বোঝালে নানারকম গোলযোগ দেখা দেয়। প্রথমত, বিস্মৃত করিয়ে দিলে বলতে কাকে বিস্মৃত করিয়ে দিলে? নবীজী (সাঃ)সহ সকল সাহাবীদের একযোগে? একবার লেখা হলে তারপর আর সেটা বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ থাকে কি? যদি রহিতও হয় তবুওতো সে আয়াত কোরআনে লেখা রয়েছে। ফলে সেটা বিস্মৃত হওয়া কি সম্ভব? সমপর্যায়ের আয়াত আনারও মানে বোঝা মুশকিল। কোরআনেই যদি একইরকম আয়াত থাকে তাহলে আবার সমপর্যায়ের আয়াত আনার দরকার কি?
১৬:১০১ আয়াত মনোযোগ দিয়ে পড়লেও বোঝা যাবে এখানে কোন আয়াত প্রতিস্থাপনের কথা বলা হচ্ছে। ‘তারা বলে , আপনি তো মনগড়া উক্তি করছেন।’ এটা নিশ্চয়ই সাহাবীদের কথা নয়। নিশ্চিতভাবেই এটা কিতাবীদের কথা। তাদের কিতাব থেকে ভিন্ন আয়াত নাজিল হওয়ার কারণেই তারা অভিযোগ করছে। আপত্তিটা তারা করছে তাদের কিতাবের আয়াতকে নাকচ করা হচ্ছে, সেকারণে। কোরআনের আয়াত রহিত করার কথা হলে তা নিয়ে কিতাবীদের আপত্তি থাকার কথা নয়।
প্রেক্ষাপটসহ আয়াত ২টি পড়লেও বোঝা যাবে এখানে আলাপ হচ্ছে তৎকালীন ইহুদী ও খৃস্টানদের বিষয়ে। এবং যে আয়াতের কথা বলা হচ্ছে সেটি পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ সম্পর্কিত আয়াত। আগের অনেক আয়াত মানুষ বিস্মৃত হয়ে গেছে বা কিতাবিরা লুকিয়ে রেখেছে যা কোরআনে সঠিকভাবে বর্ণনা করে দেওয়া হয়েছে। ইহুদীদের বা খৃস্টানদের খাওয়া-দাওয়া বা অন্যান্য প্রসঙ্গে যেসব বিধান ছিল তার অনেকগুলি মুমিনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না, সেসেব ক্ষেত্রে নতুন বিধান এসেছে।
আয়াত দুটিতে এসব প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে আমরা অতীতের সমপর্যায়ের বা তার চেয়েও উত্তম আয়াত আনয়ন করি কিংবা বিষ্মৃত আয়াতের অনুরুপ আয়াত নাজিল করি। (উল্লেখ্য,আয়াত শব্দটিকে কেবলমাত্র কোরআনের বাক্য অর্থেই ব্যবহার করাও ঠিক নয়। নিদর্শন, মোজেযা, চিহ্ন ইত্যাদি অর্থেও এর ব্যবহার রয়েছে।)
যাহোক, মূলত হাদিসের ভিত্তিতেই এই নাসখ বা রহিত আয়াতের প্রচারণা শুরু হয়। বুখারি শরিফ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) থেকে কয়েকটি নমুনা দেয়া যাক।
১. সপ্তম খন্ডের ৪১৫৪ ও ৪১৫৫ নং হাদিসে বলা হচ্ছে ২:১৮৪ আয়াতের রোজা রাখায় সমর্থদের ফিদিয়ার সুযোগ ২:১৮৫ দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। ৪১৫৩ নং হাদিসে ইবনে আব্বাসের বরাতে বলা হচ্ছে, আয়াত রহিত হয়নি। এই হুকুম অতিবৃদ্ধ পুরুষ ও নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
১. সপ্তম খন্ডের ৪১৫৪ ও ৪১৫৫ নং হাদিসে বলা হচ্ছে ২:১৮৪ আয়াতের রোজা রাখায় সমর্থদের ফিদিয়ার সুযোগ ২:১৮৫ দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। ৪১৫৩ নং হাদিসে ইবনে আব্বাসের বরাতে বলা হচ্ছে, আয়াত রহিত হয়নি। এই হুকুম অতিবৃদ্ধ পুরুষ ও নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
২. সপ্তম খন্ডের ৪১৭৪ নং হাদিসে বলা হচ্ছে, হযরত উসমান কোরআন শরিফের অনুলিপিতে ২:২৩৪ আয়াত যুক্ত করলে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র তাকে বলেন যে এ আয়াত তো রহিত হয়েছে। এটা লিখছেন কেন? জবাবে উসমান বলেন, আমি মূল পান্ডুলিপি থেকে কোন জিনিস পরিবর্তন করব না। আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র বলেননি যে তিনি কার কাছ রহিত হওয়ার কথাটি শুনেছেন।
৩. সপ্তম খন্ডের ৪১৭৫ নং হাদিসে বলা হচ্ছে, ২:২৪০ আয়াত দিয়ে বাড়িতে ইদ্দত পালনের বিধান রহিত হয়েছে। মুজাহিদ, ইবনে আতা, ইবনে আব্বাসসহ বিভিন্ন সাহাবী এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন।
৪. সপ্তম খন্ডের ৪১৮৯ ও ৪১৯০ নং হাদিসে বলা হচ্ছে যে, মারওয়ান আল আসফার কোন এক সাহাবীর বরাতে বলেন, ২/২৮৪ রহিত হয়েছে।
৫. অষ্টম খন্ডের ৪৪০১ নং, ৪৪০২ নং হাদিস বলছে, ১৭:৩৩ আয়াত রহিত হয়েছে ৪:৯৩ দ্বারা। ইত্যাদি।
ইন্টারেস্টিং হলো, এসব হাদিসের কোনটিই রাসুলের (সাঃ) বরাতে বিবৃত হয়নি। সবই সাহাবীদের আন্দাজ অনুমান। হাদিসগুলি পড়লে বোঝা যায়, আয়াত রদের আলোচনা কেবলমাত্র সাহাবীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ ব্যাপারে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন।
কোরআনে কতটি আয়াত নাসখ বা রহিত হয়েছে তা নিয়েও প্রচারণাকারীদের মধ্যে তুমুল বিভ্রান্তি রয়েছে। ৫০০ আয়াতের কথাও বলেন কেউ কেউ। আবার ইবনে সালামা ও আল ফারিসির ধারণা ২০০টি আয়াত বাতিল/রহিত। ইবনে শিহাব আল যুহরির দাবি এরকম আয়াতের সংখ্যা ৪২টি। শাহ ওয়ালিউল্লাহর মতে ৫টি। আবদুল হক হক্বানী এই ৫টি থেকে ২টি নাছিখ নয় বলে প্রমাণ করেছেন।
নাসখ আয়াত নিয়ে পশ্চিমা পন্ডিতরাও উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। জন বার্টন বিস্তারিত গবেষণার পর মাত্র ২টি আয়াতকে নাসখ বলে অনুমান করেছেন।
সংখ্যার এই বিস্তর ফারাক দেখেই বোঝা যায়, বিষয়টি নিয়ে রহিতপন্থীতের মধ্যে একধরণের ঔদাসিন্য, খামখেয়ালিপনা ছিল। বস্তুত, কোরআনের একটি আয়াতও রহিত বা বাতিল বলার চেয়ে পুরো গ্রন্থটিই বাতিল বলা অনেক সহজ। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মোহাম্মদ আবদুহ’র বক্তব্য- ‘কোরআনে পরষ্পরবিরোধী বা রহিত আয়াত একটিও নেই। …২৩ বছর ধরে নাজিল হওয়া গ্রন্থের আয়াতকে যদি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য বদলে ফেলতে হয়, তাহলে ১৪০০ বছর পর সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপুল বদলের প্রেক্ষিতে গোটা কোরানই বদলে ফেলা উচিত।’ মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছাড়াও অধুনা অনেক ইসলামি পন্ডিতই আবদুহ’র বক্তব্যের সঙ্গে একমত।
তথাকথিত কিছু রহিত ও নতুন আয়াত বিবেচনা করা যাক।
১.
রহিত আয়াত ২:২৮৪ যদি তোমার মনের কথা প্রকাশ কর কিংবা গোপন কর, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন।
নতুন আয়াত ২:২৮৬ আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার উপর বর্তায় যা সে করে।
নাসখ/রহিতপন্থীদের দাবি প্রথম আয়াতে মানুষ মনের ইচ্ছার জন্যও দায়ী হবে। কিন্তু পরের আয়াতে বলা হয়েছে মানুষ শুধুমাত্র তার কর্মের জন্যই দায়ী হবে। সুতরাং মনের ইচ্ছা সংক্রান্ত আয়াত বাতিল। অথচ ২৮৩ আয়াতের সাথে ২৮৪ আয়াতটি মিলিয়ে পড়লেই বোঝা যেতো এখানে অন্তরের ইচ্ছার কথা নয়, বরং সাক্ষ্য গোপন করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা সাক্ষ্য গোপন করে তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
২৮৩-৮৪ … তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে কেউ তা গোপন করবে, তার অন্তর পাপপূর্ণ হবে। তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে খুব জ্ঞাত। যা কিছু আকাশসমূহে রয়েছে এবং যা কিছু যমিনে আছে, সব আল্লাহরই। যদি তোমরা মনের কথা প্রকাশ কর কিংবা গোপন কর, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন।
২৮৪ আয়াতে প্রকাশ করে ও গোপন করে শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে, এবং ২৮৬ আয়াতের শব্দ দুটি হলো উপার্জন করে এবং যা সে করে। প্রকাশ করা এবং গোপন করা সাক্ষ্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। যে কেউ সাক্ষ্য দিতে পারে বা তা গোপন করতে পারে। অন্যদিকে উপার্জন করা এবং কোন কিছু করা মূলত আমাদের আমলের বা কর্মের কথাই বলে। ২৮৩ ও ২৮৪ পরপর আয়াত দুটি একই বিষয় অর্থাত্ সাক্ষ্য সম্পর্কিত। ফলে এখানে ২৮৪ ও ২৮৬ আয়াতের মধ্যে সামান্যতম বিরোধের আভাসও নেই।
২.
রহিত আয়াত ২:৬২ নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী, নাসারা ও সাবেঈন, যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি এবং সত্কাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।
নতুন আয়াত ৩:৮৫ যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত।
রহিতপন্থীদের দাবি, ২:৬২ বলছে যে কিছু ইহুদী ও খৃস্টানরা পুরস্কৃত হবে। এটা ৩:৮৫ আয়াতে বাতিল হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে মুসলিম ছাড়া সবাইকে পস্তাতে হবে।
মূলত, এখানে বিপত্তিটা হয়েছে ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত/সঙ্কীর্ণ ধারণা থেকে। কোরআনে আল্লাহ একাধিকবার জানিয়েছেন ইসলাম কোন নতুন ধর্ম নয়। হযরত ইব্রাহিম (সাঃ) মুসলিম ছিলেন, তিনিই আমাদের নামকরণ করেন মুসলিম হিসেবে (২:১২৮, ১৩১, ১৩৩, ২২:৭৮)। ৩:৬৭ আয়াতেই আল্লাহ সরাসরি বলছেন যে ইব্রাহিম (সাঃ) ইহুদীও ছিলেন না খৃস্টানও ছিলেন না, তিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী মুসলিম। ৫:১১১ আয়াতে হযরত ঈসা (সাঃ) ও তার অনুসারীদেরকে মুসলিম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২৭:৪৪ আয়াতে সোলায়মানকে (সাঃ) মুসলিম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ৫:৪৪ আয়াতে তাওরাত দেওয়া হয়েছে এমন সব নবীকেই মুসলিম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সব আয়াতে যাদের মুসলিম বলে উল্লেখ করা হয়েছে তারা তাওরাত ও ইঞ্জিল অনুসরণ করতেন, কোরআন সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না। ইসলামের যে পাঁচ স্তম্ভের কথা আমরা বলি তার সব কটিই ইব্রাহিম (সাঃ) এর সময়ে প্রবর্তিত। মূলত কোরআনে মুসলিম বলতে তাকেই বোঝানো হয়েছে যে এক আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করে, শিরক করে না, পরকালে বিশ্বাস করে এবং ভাল কাজ করে, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন।
সুতরাং ২:৬২ আয়াতে যাদের কথা বলা হয়েছে ৩:৮৫ আয়াতের লক্ষ্য তারা নয়। ফলে এর মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
৩.
রহিত আয়াত ২:১১৫ পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। অতএব তোমরা যেদিকে মুখ ফেরাও, সেদিকে সেদিকেই আল্লাহ বিরাজমান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বব্যপী, সর্বজ্ঞ।
নতুন আয়াত ২: ১৪৪ .. অতএব অবশ্যই আমি আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেদিক থাক সেদিকে মুখ কর।
রহিতপন্থীদের দাবি থেকে মনে হয় যে, ১১৫ আয়াতে আল্লাহ পূর্ব বা পশ্চিম বা অন্য যে কোন দিককেই কিবলা হিসেবে অনুমোদন দিয়েছিলেন। পরে ১৪৪ আয়াতে এসে কেবল মসজিদুল হারামের দিকে কিবলা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। অথচ তারা মনোযাগ দিয়ে পড়লে বুঝতেন, ১১৫ আয়াতে কিবলার কোন কথাই বলা হয়নি। আল্লাহ যে সর্বত্র বিরাজমান সে কথাই বলা হয়েছে। আমরা যেদিকেই যাই না কেন, যেদিকেই মুখ করি সেদিকেই আল্লাহ আছেন। এই আয়াতে কিবলা শব্দটির উল্লেখমাত্র নেই, নেই মসজিদুল আকসার কথা। বরং আয়াতের শেষে আল্লাহ সর্বব্যাপী কথাটা দিয়ে আয়াতের বার্তাটিকে আরো পরিস্কার করা হয়েছে। মূলত ১৪৪ আয়াতের আগে কোথাও কিবলা নির্ধারন করে কোন আয়াত নাজিল হয়নি। এই আয়াতে কিবলা শব্দটি দিয়ে সালাতের দিক নির্ধারণের ব্যাপারে মসজিদুল হারামের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এবং এটাও যে নবীর পছন্দের কারণে করা হচ্ছে সেটিরও ইঙ্গিত রয়েছে। নইলে আল্লাহর কাছে তো সব দিকই সমান যেটা ১১৫ আয়াতে আগেই বলা হয়েছে। আগের কিবলাটি নবী ও তার উম্মতরা তাদের পছন্দমাফিক ঠিক করে নিয়েছিলেন। হয়তো কিবলার কোন নির্দেশ না থাকার কারণে মদীনার ইহুদীদের কিবলাটিই তারা বেছে নিয়েছিলেন। এর সঙ্গে নবীজীর (সাঃ) সামাজিক-রাজনৈতিক বিবেচনাও কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু কোনক্রমেই এটি কোরআনের নির্দেশ ছিল না। ফলে রহিতকরণের ধারণাটি ভুল।
৪.
৫:১০৬ হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্যে যখন কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন অছিয়ত করার সময় তোমাদের মধ্য থেকে ধর্মপরায়ণ দুজনকে সাক্ষী রেখো। তোমরা সফরে থাকলে এবং সে অবস্থায় তোমাদের মৃৃত্যু উপস্থিত হলে তোমরা তোমাদের ছাড়াও দু ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখো। …
৬৫:২ অতঃপর তারা যখন ইদ্দতকালে পৌছায়, তখন তাদেরকে যথোপযুক্ত পন্থায় রেখে দেবে অথবা যথোপযুক্ত পন্থায় ছেড়ে দেবে এবং তোমাদের মধ্যে থেকে দুজন নির্ভরযোগ্য লোককে সাক্ষী রাখবে। …
দাবিটা হলো, ৫:১৬ আয়াতে সফরে থাকলে যে কোন দুজন সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে যারা আত্মীয় বা ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়া জরুরী নয়। ৬৫: ২ আয়াতে সাক্ষী আত্মীয় বা নিকট বন্ধু থেকেই হতে হবে। ফলে আগের আয়াতটি বাতিল। কিন্তু এই কথার কোন ভিত্তি নেই। কারণ, ৫:১০৬ আয়াতটি হলো মৃত্যুপথযাত্রী কারো উইল করার প্রসঙ্গে। আর ৬৫:২ আয়াতটি তালাক প্রসঙ্গে। সফরে থাকা অবস্থায় কাছে আত্মীয় স্বজন নাও থাকতে পারে। যে কারণে আত্মীয়স্বজনের মধ্য থেকে সাক্ষী রাখার বিষয়টি আল্লাহ শিথিল করেছেন। কিন্তু তালাকের ক্ষেত্রে এরকম জরুরী অবস্থার তৈরি হয় না। ফলে আত্মীয় স্বজনের সাক্ষী হওয়াটা শর্ত হিসেবে রয়েছে। ফলে কোনভাবেই একটি আয়াত আরেকটিকে খারিজ করছে না।
৫.
রহিতআয়াত ৪:৪৩ হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত (আরবী সুকারা) থাক, তখন নামাজের ধারে কাছেও যেওনা, যতক্ষণ না বুঝতে সক্ষম হও যা কিছু তোমরা বলছ।
২:২১৯ তারা তোমাকে মদ (আরবী খামর) ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলে দাও, উভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও আছে। তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়।
নতুন আয়াত ৫:৯০ হে মুমিনগণ! এই যে মদ (আরবী খামর), জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কাজ বৈ তো নয়। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক (আরবী ফা-ইযতানিবুহু) যাতে তোমরা কল্যানপ্রাপ্ত হও।
প্রথমে ৪:৪৩ আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। আয়াতটিতে কোনক্রমেই শুধু নেশাদ্রব্যের কোন কথা বলা হচ্ছে না। আরবীতে সাধারণত খামর শব্দটি দিয়ে মদ বা নেশাদ্রব্যকে বোঝানো হয়। এখানে শব্দটি ব্যবহারই করা হয়নি। বলা হয়েছে সুকারার কথা। সুকারা বলতে আরবীতে কেবলমাত্র নেশাদ্রব্য বোঝায় না, যে কোন কিছু যা চৈতন্যকে, স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে তাকেই বোঝায়। বিভ্রান্তিকর কোন পরিস্থিতি, প্রচন্ড ক্রোধ, গভীর দুঃখ, নিদ্রাচ্ছন্নতা ইত্যাদি মানসিক অবস্থাও আমাদের চিন্তার স্বচ্ছতাকে ব্যহত করে, আচ্ছন্ন করে। নেশাদ্রব্যও করে। এবং এর সবগুলিই এই সুকারার আওতায় পড়ে। (দেখুন এডোয়ার্ড লেনের অ্যারাবিক-ইংলিশ লেক্সিকনের ভলিউম ৭ পৃষ্ঠা ১৩০০। রাগিব ইসপাহানি’র মুফরাদাত, কিংবা ইবনে মুকাররামের লিসান আল আরবেও একই মত প্রকাশ করা হয়েছে-মোহাম্মদ আকরাম খাঁ।) কোরআনের একাধিক আয়াতেও এর নমুনা দেখা যেতে পারে। (৫০:১৯, ১৫:১৫ ইত্যাদি।)
ফলে, ৪:৪৩ আয়াতে বলা হচ্ছে, এমন কোন অবস্থায় নামাজে না দাড়ানোর জন্য যখন নামাজির চৈতন্য আচ্ছন্ন এবং সে কী বলছে তা সে বুঝতে পারছে না। এখানে আয়াতের মূল ফোকাস যত না সুকারার সঙ্গে তার চেয়ে বেশি নামাজে একজন যা পড়বে তা যেন সে বোঝে তার উপর।
২:২১৯ আয়াতটি মনোযোগ দিয়ে পড়লেও বোঝা যাবে, এখানে মদ হারাম হওয়া না হওয়ার কোন বার্তা নেই। বরং জিজ্ঞাসিত হয়ে মদের এবং জুয়ার অবস্থা/গতিক বিচার করে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। এবং বলা হচ্ছে যে, পাপের পরিমাণ অনেক বেশি। পাপ শব্দটিও কোরআনে কীভাবে ব্যবহূত হয়েছে সেটিও লক্ষ্য করা যেতে পারে (২:১৭৩, ১৮১, ৪:৪৮, ৫০, ৫:২৯, ৬২, ৬:১২০, ৭:৩৩, ,২৪:১১, ৪৯:১২, ৫৩:৩২ ইত্যাদি)। ৫৩:৩২ ছাড়াও বেশ কিছু আয়াতে বড় গুনাহকে ক্ষমা করা হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং ২:২১৯ আয়াতে মদের বিষয়টিকে কবিরা গুনাহ (ইছমুন কাবিরুন) হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে মদ ও জুয়া উভয় দোষের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ৫:৯০-৯১ আয়াতটিতে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। অনেকে বলেন, কোরআনে শুকরের মাংসকে যেভাবে হারাম করা হয়েছে মদকে সেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ৫:৯০ আয়াতে হারামের বদলে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি হলো ইযতানিবু। শব্দটি কোরআনে কীভাবে ব্যবহূত হয়েছে সেটিও দেখা যাক।
১৬:৩৬ আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাগুত বর্জন কর (আরবী ইযতানিবু)।
২২:৩০… সুতরাং তোমরা বর্জন কর মূর্তিপূজার অপবিত্রতা (আরবী ফা-ইযতানিবু) এবং দুরে থাক মিথ্যা কথন থেকে (আরবী ওয়া-ইযতানিবু)।
কোন মুসলিম বা কোরআনের নিবিষ্ট পাঠক নিশ্চয়ই বলবেন না যে, কোরআন এখানে তাগুত বা মিথ্যা দেবদেবী বর্জন করা কিংবা মিথ্যা না বলার ব্যাপারে কেবল সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছে বা শুধুমাত্র উপদেশ দিয়েছে। উপরের আয়াতগুলো বিবেচনায় নিলে মদ্যপান বর্জন করার পরামর্শকে শুধুমাত্র সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ বলে মেনে নেওয়া কঠিন।
৬.
রহিত আয়াত ২:২৩৪ আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং নিজেদের স্ত্রীদের ছেড়ে যাবে, তখন সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো নিজেকে ৪ মাস ১০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা। তারপর যখন ইদ্দত পূর্ণ করে নেবে, তখন নিজের ব্যাপারে নীতিসঙ্গত ব্যবস্থা নিলে কোন পাপ নাই। আর তোমাদের যাবতীয় কাজের ব্যাপারেই আল্লাহর অবগতি রয়েছে।
নতুন আয়াত ২:২৪০ আর যখন তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে তখন স্ত্রীদের ঘর থেকে বের না করে এক বছর পর্যন্ত তাদের খরচের ব্যাপারে ওসিয়ত করে যাবে। অতঃপর সে স্ত্রীরা যদি নিজে থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে সে নারী যদি নিজের ব্যাপারে কোন উত্তম ব্যবস্থা করে, তবে তাতে তোমাদের উপর কোন পাপ নাই। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশালী বিজ্ঞতাসম্পন্ন।
দাবি হলো, ২:২৪০ আয়াতে বলা হচ্ছে নারী তার স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দতকাল ১ বছর। কিন্তু ২:২৩৪ আয়াতে বলা হচ্ছে ৪ মাস ১০ দিন। সুতরাং এর একটা বাতিল। অথচ এখানে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিধান দেয়া দুটি আয়াতের একটিতেও ইদ্দত শব্দটিই ব্যবহূত হয়নি। ইদ্দতের উল্লেখ আছে ৩৩:৪৯, ৬৫:৪ ইত্যাদি আয়াতে। যে কেউ সরলভাবে পাঠ করলেই বুঝবেন ২:২৪০ কোন অর্থেই ইদ্দতের বিধান নয়, বন্দোবস্ত/খোরপোষের কথা বলা হয়েছে এখানে। এখানে স্ত্রীর গর্ভধারণ করা না করা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। ইদ্দতের বদলে আছে আরবি ‘মাতা’ (বন্দোবস্ত, খোরাকি)। ২:২৩৪ আয়াতের বিধান পুরোপুরি মানতে হবে। ২৪০ আয়াতে ফ্লেক্সিবিলিটি আছে।
আরেকটি ইন্টারেস্টিং বিষয়, রহিতপন্থীদের দাবি মোতাবেক নতুন আয়াত রহিত আয়াতের পরে আসার কথা। এখানে দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। তাফসিরুল কোরআনে মোহাম্মদ আকরম খাঁ আল ইসপাহানির বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছেন, রহিত আয়াতের আগে নতুন আয়াত আসাটা খুবই দুর্বল কাঠামো, এটা মহান আল্লাহর কাজ হিসেবে মানা মুশকিল। ( মুলতাক্বাত তামি আল তাউইল্লি মুকহাম আল তানজিল, পৃষ্ঠা ২৯)।
৭.
রহিতআয়াত ৯:৪৩ আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন, আপনি কেন তাদেরকে অব্যাহতি দিলেন, যে পর্যন্ত না আপনার কাছে পরিস্কার হয়ে যেত সত্যবাদী কারা এবং জেনে নিতেন মিথ্যাবাদীদের।
নতুন আয়াত ২৪:৬২ মুমিন তো তারাই যারা আল্লাহর ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং রাসুলের সাথে কোন সমষ্টিগত কাজে শরীক হলে তাঁর কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ ব্যতীত চলে যায় না। যারা আপনার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে, তারাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। অতএব তারা আপনার কাছে তাদের কোন কাজের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলে আপনি তাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুমতি দেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, মেহেরবান।
দাবি, ৯:৪৩ আয়াতে নবীকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ২৪:৬১ তে দেওয়া হয়েছে। এখানেও পার্থক্যটা খুব পরিস্কার। ৯:৪৩ আয়াতে যুদ্ধের প্রসঙ্গে, অনেক মুনাফিক যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য টালবাহানা করত, নানারকম অজুহাত দেখাত। আর ২৪:৬২ আয়াত কমিউনিটি মিটিং থেকে কারো চলে যাওয়ার ব্যাপারে। ৯:৪৩ আয়াতের ঠিক আগের দুটি আয়াত পড়লেও বিষয়টি পরিস্কার হয়।
৯:৪১-৪২ তোমরা বের হয়ে পড় স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে এবং জেহাদ করো আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে, এটি তোমাদের জন্য অতি উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পার। যদি আশু লাভের সম্ভাবনা থাকতো এবং যাত্রাপথও সংক্ষিপ্ত হতো, তবে তারা অবশ্যই আপনার সহযাত্রী হতো, কিন্তু তাদের নিকট যাত্রাপথ সুদীর্ঘ মনে হলো। আর তারা এমনই শপথ করে বলবে, আমাদের সাধ্য থাকলে অবশ্যই তোমাদের সাথে বের হতাম, এরা নিজেরাই নিজেদের বিনষ্ট করছে, আর আল্লাহ জানেন যে এরা মিথ্যাবাদী।
এখানে খুব পরিস্কার যুদ্ধে যোগদানের বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে আয়াতে। ২৪:৬১ এ তা নয়। সেখানে সাধারণ কমিউনিটি মিটিং এর কথা বলা হয়েছে। ফলে এ দুটি থেকে অব্যাহতি পাওয়া একই রকম অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
(আগ্রহী পাঠক John Burton এর The Sources of Islamic Law: Islamic Theories of Abrogation বইটি পড়ে দেখতে পারেন। বইটি অনলাইনে সহজলভ্য।)