ইসলামের ইতিহাসে এমনটাই লেখা আছে বটে। কিন্তু এই ইতিহাস পুরোটাই বিভিন্ন অপ্রামাণিক সেকেন্ডারি সোর্সের উপর ভিত্তি করে রচিত।
উপরন্তু, কোরআনের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকেও এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। তত্কালীন আরব দেশের প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে মনোযোগের সঙ্গে কোরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি বিবেচনা করলেও এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, কোরআন নবীর জীবত্কালেই লিখিত ও যথাযথভাবে সংকলিত হয়েছিল।
কথা নয় যে, কোরআন নবীর জীবত্কালেই লিখিত ও যথাযথভাবে সংকলিত হয়েছিল।একটি বিষয়ে বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী গবেষক/ঐতিহাসিক কারোরই দ্বিমত নেই যে, নবীর সমসাময়িককালের আরব দেশের ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে কোরআনই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। কোরআনের আগের আরবী ভাষার কোন লিখিত গ্রন্থের হদিশ আমরা এখনো পাইনি। অনেকে ইমরুল কায়েস থেকে শুরু করে আল হারিসের কবিতা তথা ঝুলন্ত পদ্যের কথা বলে থাকেন। এগুলিও যে পরবর্তীকালের রচনা সেকথা দি সেভেন ওডস বইয়ের ভূমিকাটিতে খুব পরিস্কার করেই লেখা আছে।
‘Here it suffices to remark that Arabia has not yielded so far any ancient inscriptions in verse, that no old codices or papyri from the pre-islamic period have come down to us, and that the oldest book in Arabic literature, in the usual sense of the term, is the Koran. Yet by the end of the eighth century men were beginning to collect and edit, of course in manuscript, the ‘works’ of individual poets believed to have lived before islam. (The Seven Odes, A J Arberry, Prolouge page 14)
অনলাইনে বইটি সহজলভ্য। লিংক: https://kupdf.com/…/arthur-john-arberry-the-seven-odes…
আদিতম উত্স হিসেবে কোরআনের তথ্যগুলিকে বিচার-বিবেচনা করলে কোরআন সংকলনের প্রচলিত তত্ত্বগুলি অর্থহীন মনে হবে। যেমন, গাছের পাতায়, পশুর চামড়ায় কোরআন লেখা হয়েছিল, এর কিছু আয়াত হারিয়ে গিয়েছিল, কিছু আয়াত লেখা কাগজ ছাগলে খেয়ে ফেলায় সেগুলি আর সংযোজন করা যায়নি, সম্পাদনা কমিটির মাধ্যমে কোরআনের আদর্শ একটা কপি তৈরি করে বাকিগুলি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন, এর কিছু অংশ বাদ দিয়েছিলেন ইত্যাদি।
বিচার ১.
মুসলিমদের অনেকেই মনে করেন গাছের পাতা, পশুর হাড়ের মতো অনিরাপদ, ঠুনকো উপাদানেও কোরআন লিখিত হয়েছিল।
তত্কালীন আরবের সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ধারণাটি খুবই অদ্ভুত। এ থেকে মনে হয় তখনকার আরবরা খুবই আদিম অবস্থায় ছিল, লেখালেখি বা বইপুস্তকের কোন ধারণা সেখানে ছিল না। ফলে তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে কাগজে লিখে সংকলন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অথচ বাস্তব অবস্থা এর বিপরীত। মক্কায় তো বটেই, মদিনাতেও ইহুদী -খৃস্টানরা তাদের পবিত্র গ্রন্থগুলি কাগজে লিখেই সংকলন করেছিল। কোরআনের অনেক আয়াতে তাদের কিতাবের কথাও উল্লেখ আছে। হুদাইবার সন্ধিসহ বিভিন্ন চুক্তিও তত্কালে কাগজেই সম্পন্ন হতো। এছাড়াও লিখিত চুক্তি সম্পাদনের উপরও কোরআনে জোর দেওয়া হয়েছে। (২:২৮২, ২৪:৩৩) কোরআনের একাধিক আয়াত বিবেচনা করলেও এ ধারণাকে অসার মনে হবে।
২:৭৯ সুতরাং দুর্ভোগ তাহাদের জন্য যাহারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছ মূল্য প্রাপ্তির জন্য বলে, ইহা আল্লাহর নিকট হইতে।
২৫:৫ উহারা বলে,এইগুলি তো সেকালের উপকথা যাহা সে লিখিয়াছে,এইগুলি সকাল-সন্ধ্যায় তাহার নিকট পাঠ করা হয়।
৬:৯১ …বল,কে নাযিল করিয়াছেন মূসার আনীত কিতাব যাহা মানুষের জন্য আলো ও পথনির্দেশ ছিল, তাহা তোমরা বিভিন্ন পৃষ্ঠায় (ক্বারাতিসা) লিপিবদ্ধ করিয়া কিছু প্রকাশ কর ও যাহার অনেকাংশ গোপন রাখ।.. ..
৮০:১৩-১৬ .. উহা আছে মর্যাদাসম্পন্ন লিপিসমূহে। যাহা উন্নত ও পবিত্র। মহান, পূত-চরিত্র লিপিকর হস্তে লিপিবদ্ধ।
ফলে,বোঝাই যাচ্ছে,স্মৃতি চর্চার পাশাপাশি নবীর সমকালে লেখার চর্চাও ভালোভাবেই ছিল। এবং নবীন এক শক্তিশালী বিশ্বাসী সম্প্রদায় তাদের পবিত্র গ্রন্থকে সুরক্ষা দেবার সুযোগটি কাজে লাগায়নি, এমনটা বিশ্বাস করার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। নবীর সময়ে কিতাবি সম্প্রদায় ছিল, তারা আরবী ভাষায় কথা বলতো, কোরআনে বহুবার তাদের কথা বলা হয়েছে। তারা যদি তাদের পবিত্র গ্রন্থ লিখিতভাবে সংরক্ষণ করতে পারে তাহলে নবীন বিশ্বাসী সম্প্রদায় তাদের ধর্মগ্রন্থকে কেন গ্রন্থবদ্ধ করতে পারবে না?
বিচার ২.
ইতিহাস ও হাদিসের বরাতে অধিকাংশ মুসলিম মনে করেন, কোরআন নবীজী সংকলন করে যাননি।
এক্ষেত্রেও সাধারণ বুদ্ধি প্রয়োগ যথেষ্ট। অন্য সব বিবেচনা বাদ দিলেও, একটি ঐশি গ্রন্থ যা মানবজাতিকে পথ প্রদর্শন করবে বলে তত্কালীন আরবরা মনে করতো সেটির যথাযথ সংকলন অনির্দ্দিষ্টভাবে পরবর্তীদের ইচ্ছা এবং স্মৃতির উপরে ছেড়ে রাখা কোন কাজের কথা নয়। বিশেষ করে যে জাতি সততই যুদ্ধাবস্থায় লিপ্ত ছিল তাদের পক্ষে অন্য সব সম্ভাবনার মধ্যে গ্রন্থটি যথাযথভাবে সংকলিত করে রাখার সম্ভাবনাই বেশি। লেখার উপাদান থাকা এবং বিশেষ করে তাদেরই সমসাময়িক ইহুদী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কাছে তাদের ঐশি গ্রন্থ তাওরাত ও বাইবেল সংকলিত অবস্থায় থাকার কারণে এই সম্ভাবনা আরো বেশি।
কোরআন যে নবীর জীবত্কালেই যথাযথভাবে সংকলিত হয়েছিল তার নমুনা হিসেবে দুটি আয়াতের কথা বলা যায়।
২৫:৩২- কাফিররা বলে, সমগ্র কোরআন তাহার নিকট একবারে অবতীর্ণ হইল না কেন? এইভাবেই আমি অবতীর্ণ করিয়াছি তোমার হূদয়কে মজবুত করিবার জন্য এবং উহাকে সজ্জিত করেছি যেভাবে সাজানো উচিত (রাতালনাহু তারতিলা)।
অনেকে আয়াতের শেষাংশটুকু অনুবাদ করেন ‘এবং উহাকে ক্রমে ক্রমে স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করিয়াছি’। মূলত ‘রাতালনাহু তারতিলা’ বাগধারাটি পরিস্কারভাবে নির্দেশ করে বিভিন্ন অংশকে সাজিয়ে উত্তমভাবে নির্মিত কোন কিছুর কথা। একই আয়াতে নবীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রেক্ষিত বিবেচনা করলেও বিষয়টি বোধগম্য হবে। অবিশ্বাসীরা তাকে প্রশ্ন করেছিল, সমগ্র কোরআন কেন একসঙ্গে (জুমলাতান ওয়াহিদাতান) অবতীর্ণ করা হলো না? অর্থাত্ একটি সুগ্রন্থিত অখন্ড বই হিসেবে। নবীর সমসাময়িককালের লোকদের প্রশ্নের জবাবে এটা পরিস্কার করেই বলা হয়েছে যে বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতেই আয়াত অবতীর্ণ হয়। বিচ্ছিন্নভাবে অবতীর্ণ হলেও পরিকল্পিত ও সঠিকভাবেই সজ্জিত এর আয়াতগুলো।
এখানে রাত্তিলি ও তারতিলান দুটো শব্দরই শব্দমুল রা তা লাম। যার অর্থ কোন কিছুকে নির্দিষ্ট বিন্যাসে, সঠিক সজ্জায় সাজানো বা বিন্যস্ত করা। (দেখুন এডওয়ার্ড উইলিয়াম লেনের অ্যান অ্যারাবিক-ইংলিশ লেক্সিকন বইয়ের ১০২৮ পৃষ্ঠা, অথবা আবদুল মান্নান ওমরের ডিকশনারি অব দি হোলি কোরআন পৃষ্ঠা ২০১)
উভয় অভিধানেই শব্দটির মূল অর্থ সুসমঞ্জস/সঠিক সজ্জা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। শব্দটি মূলত সামনের সারির দাঁতের তুলনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যার প্রতিটি আলাদা কিন্তু সবগুলি মিলে একটি সামঞ্জস্য বিধান করে। রাতিলা শব্দটির অর্থ প্রসঙ্গে এডওয়ার্ড লেন সামনের সারির দাঁতের কথা বলে এর মূলার্থ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘well set together’। উদাহরণ দিয়ে বলেছেন ‘ The thing was or became, well arranged or disposed.’ তারতিলান এর অর্থ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন ‘In its original sense, relates to the teeth.’। উদাহরণ
দিতে গিয়ে তিনি তারতিলুন এর অর্থ করেছেন ‘He put together and arranged well the component parts of the speech, or saying and made it distinct’। আবদুল মান্নান ওমরও তার অভিধানে রাতিলা শব্দের একেবারে প্রারম্ভিক অর্থ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘To set in order, make even.’। তারতিলান শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে তিনিও লিখেছেন ‘The putting of something together distinctly in a well arranged manner and without any haste.’। জওহারি, কামুস ও লিসানের রেফারেন্স দিয়ে ওমর লিখেছেন, রাতিল আল-কালাম মানে হবে ‘he put together and rearranged well the component part of the speech or saying.’। (রাতিল শব্দটার একাধিক অর্থ আছে যার একটি আবৃত্তি করা। যখন এটি আবৃত্তির প্রসঙ্গে ব্যবহূত হবে তখন এটা শান্ত, পরিমিত উচ্চারণে পঠনের কথা বোঝাবে যে পাঠ একইসঙ্গে অর্থকেও সঠিকভাবে বোধগম্য করে তুলবে। তবে একমাত্র এই অর্থেই যে শব্দটি ব্যবহূত হবে তা নয়।)
২৫:৩২ আয়াতের অর্থও ওমর তার অভিধানে নমুনা হিসেবে অভিধানে যোগ করেছেন এভাবে- ‘We have arranged (it) in an excellent form and order.
শুধু ওমর নন, কোরআনের অনেক বিখ্যাত অনুবাদকই এই শব্দ দুটির অনুবাদ এভাবেই করেছেন। যেমন:
মোহাম্মদ আসাদের অনুবাদ We have so arranged its component parts that they form one consistent whole .
এমএম পিকথালের অনুবাদ and We have arranged it in right order.
শাকিরের অনুবাদ We have arranged it well in arranging.
সুতরাং, এই আয়াতটি ও ৭৩:৪ আয়াতটি দিয়ে বোঝা যায়, শুধু নবীর জীবত্কালেই নয়, আল্লাহর ইচ্ছাক্রমে নবীর তদারকিতেই নবীর দ্বারাই কোরআন সংকলনের কাজটি সুসম্পন্ন হয়েছে।
(৭৩:৪ আয়াতটিকেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিন্নভাবে অনুবাদ করা হয়। বলা হয় যে এখানে নবীকে ধীরে ধীরে বা যেভাবে কোরআন আবৃত্তি করা উচিত সেভাবে আবৃত্তি করতে বলা হয়েছে। অথচ উপরের সংজ্ঞার্থকে মাথায় রেখে এর অনুবাদ হওয়া উচিত- ‘.. এবং বিন্যস্ত/সজ্জিত করো (আরবী ওয়া-রাত্তিলি) কোরআনকে যেভাবে একে সাজানো উচিত/নির্দিষ্ট সজ্জায়।’ কোরআন নাজিলের শুরুর দিকের এই আয়াতের পরেপরেই ৭৩:৫ আয়াতে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ‘আমরা তোমার উপর অর্পণ করতে যাচ্ছি গুরুভার কালাম।’ অর্থাত্ বাকী কোরআন।)
উল্লেখ্য,
নবীর জীবত্কালেই দীনকে সম্পূর্ণ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে কোরআনে।
৫:৩ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অঙ্গীকার সম্পূর্ণ করিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করিলাম।
সুরা মায়িদার আয়াতটি পড়লে যে কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, দীনের বিধিবিধান তথা মূল কিতাবটিকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় রেখে, আল্লাহর পক্ষে কীভাবে সম্ভব একটি দ্বীন/ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বলে ঘোষণা দেয়া? পূর্ণ ধর্মগ্রন্থ প্রণয়ন না করে দীনকে সম্পূর্ণ করার ঘোষণা ঠিক মানানসই মনে হয় না।
তাছাড়া কোরআনে বলা আছে, কোরআন (জিকরের) সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহর, মানুষের নয়। (১৫:৯, ৭৫:১৭) এরকম প্রতিশ্রুতি হাদিসের বেলায় ছিল না, যে হাদিসের ভিত্তিতে আমরা হযরত ওসমান কর্তৃক কোরআন সংরক্ষণের কথা বলি। উক্ত আয়াত বিবেচনায় নিলেও হযরত উসমানের নিয়োগ করা কমিটি কর্তৃক সম্পাদিত/সংকলিত কোরআনের ধারণাটিকে আর গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।
কোরআনকে একাধিকবার কিতাব হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন আয়াতে। আল কিতাব টার্মটি কেবলমাত্র পরিপূর্ণ গ্রন্থের বেলাতেই উল্লেখযোগ্য। কোরআন যদি অন্তিমে ছড়ানো ছিটানো আয়াত হিসেবেই থাকতো তাহলে একে বরাবর ক্বারাতিসা, সুহুফ কিংবা এমনকি রাক্ব হিসেবেও উল্লেখ করলেই হতো। কোরআনেও এসব টার্ম একাধিকবার ব্যবহূত হয়েছে। কিন্তু তাওরাত, ইঞ্জিলের মতো কোরআনকেও কিতাব হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিতাব বলতে যদি খন্ড পুস্তক বুঝে থাকেন কেউ তাহলে ৪১:৩,৬:১১৪, ২৯:৫১ বা এরকম অনেক আয়াতের মানে কী হবে সেটা বোধগম্য নয়।
বিচার ৩.
কোরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রথম সন্দেহ তৈরি করেছে হাদিস ও অন্যান্য সেকেন্ডারি সোর্সগুলো। এসবের বরাতেই ঐতিহাসিকেরা কোরআন সংরক্ষণের বিচিত্র ইতিহাস তুলে ধরেন। অথচ অন্য অনেক হাদিসের মতো এসব হাদিসও ভুলে ভরা ও পরষ্পরবিরোধী। দুটি উদাহরণ দেয়া যাক।
১. নবীর জীবত্কালে কোরআনের সংগ্রহকারীদের যে একাধিক তালিকা রয়েছে তাতে গড়মিল স্পষ্ট। একটি তালিকাতে আবু দারদার নাম নেই, উবাই বিন কাব আছেন। অন্যটিতে উবাই বিন কাব নেই, আবু দারদা আছেন। (দেখুন বুখারি ভলিউম৫, বুক ৫৮, নাম্বার১৫৫ ও ভলিউম ৬, বুক ৬১, নাম্বার ৫২৬)। অনুমান করা যায় তাদের সমর্থকগোষ্ঠীরাই এই পরস্পরবিরোধী হাদিসের জনক।
২. কোরআনের শেষ আয়াত কোনটি তা নিয়েও রয়েছে স্পষ্ট বিভ্রান্তি। একটি হাদিসে বলা হয়েছে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ৪:১৭৬ আয়াতটি শেষ আয়াত (বুখারি ভলিউম ৬, বুক ৬০, নাম্বার ১২৯)। অন্য হাদিসে বলা হয়েছে সুদের আয়াতটি শেষ আয়াত (বুখারি ভলিউম ৬ বুক ৬০ নাম্বার ৬৭) উল্লেখ্য সুদের একাধিক আয়াত রয়েছে কোরআনে
(২:২৭৫, ২:২৭৬, ২:২৭৮, ৩:১৩০, ৪:১৬১ এবং ৩০:৩৯) এর কোনটি শেষ আয়াত সেটাও নির্দ্দিষ্ট করে বলা হয়নি।
হাদিস ও অন্যান্য সেকেন্ডারি বইয়ে কোরআন সম্পর্কিত আরো যে সব বর্ণনা মেলে তার কয়েকটি এরকম :
১. কোরআনের বেশ কিছু আয়াত খোয়া গেছে, রজমের শাস্তির আয়াত লেখা কাগজটি একটি ছাগলে খেয়ে ফেলেছিল। (সুনান ইবনে মাজাহ, বুক অফ নিকাহ, হাদিস ১৯৪৪)
২. নবীজী (সাঃ) স্যাটানিক ভার্স উচ্চারণ করেছিলেন। (আল তাবারি, তারিখ ভলিউম ১)
৩.খলিফা উসমান কোরআনের অনেকগুলি কপি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। (সহীহ বুখারি ৬.৬১.৫১০)
৪. দুধসম্পর্কের বিয়েসংক্রান্ত একটা আয়াত হারিয়ে গিয়েছিল। (সুনান ইবনে মাজাহ, বুক অফ নিকাহ, হাদিস ১৯৪৪)
৫. কোরআনের আবৃত্তিকারকরাও অনেক আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন। (সহীহ মুসলিম ভলিউম ১ বুক ৫, বুক অফ জাকাত, নাম্বার ২২৮৬)
এসব হাদিস ও বর্ণনাকে অনেকে দুর্বল, বাতিল বলে উল্লেখ করেছেন। আবার অনেকে এসবের পক্ষে সাফাই দিয়েছেন। যেমন: অনেকে ছাগলের আয়াত খেয়ে ফেলার হাদিসকে জাস্টিফাই করেছেন এই বলে যে, ওটি ছিল স্বর্গীয় ছাগল। ফলে ওটি আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটেছে।
ওমরের বরাতে হাদিস রয়েছে যে তিনি নবীর জীবত্কালে রজমের আয়াত পড়েছেন। অথচ কোরআনে রজমের আয়াত নেই। এরকম একটা গুরুতর বিধানের আয়াত কোরান সংকলনে বাদ পড়ে কিভাবে? কেউ কেউ বলেন, রজমের আয়াত নাজিল হয়েছিল, কিন্তু কোরআনে যুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কেন? জবাব নেই।
বস্তুত কোরআনের সুষ্পষ্ট সুনির্দ্দিষ্ট আয়াতের বিবেচনায় এসব হাদিসের কোন মূল্য নেই।
উপসংহার
যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই ইতিহাসের বইয়ে যে অনেক ভুল তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে তা আমরা মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন নতুন তথ্যের উন্মোচনে কিংবা পরবর্তীকালের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে জানতে পারি। বিশেষ করে হাদিসের উপর ভিত্তি করে রচিত ইতিহাসের নানা ফাঁকফোঁকর তো যুগে যুগেই উন্মোচিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে বিশিষ্ট ইসলামী মনীষীদের দ্বারাই। হাদিস ও অন্যান্য অনির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে কোরআন সংকলন ও সম্পাদনার যে কাহিনী আমরা শুনি সেটিও যে ভুলের ফসল তা নিশ্চিত। আদিতম ঐতিহাসিক সূত্র হিসেবে কোরআনের বক্তব্য আমলে নিলে কোরআন যে নবীজীর (সাঃ) জীবদ্দশাতেই সংকলিত হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। শুরু থেকেই মৌখিক ও লিখিত উভয় ফরম্যাটেই গ্রন্থটি সংরক্ষিত হয়ে ও একটি অপরটির সুরক্ষাকে নিশ্চিত করে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত হয়েছে।
(পুনশ্চঃ কোরআন কীভাবে সংকলিত বা সংরক্ষিত হয়েছে তা দিয়ে কোরআনের সত্যতা নিরুপনের কিছু আছে বলে মনে হয় না। বরং এর অন্তর্নিহিত বক্তব্যগুলিই এর সত্যতা প্রতিপাদনের একমাত্র উপায়। তা যদি কাজে না লাগে তাহলে সংকলনের যথার্থতার মূল্যও খুব বেশি নয়।)