সমকালীন আরবরা কোরআনের ব্যাপারে বহু অভিযোগ এনেছিল। এটা ম্যাজিক, কবিতা, মিথ্যা রচনা ইত্যাদি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা মেনে নিয়েছেন যে, না, তাদের সঙ্গী কবি নন, উন্মাদ নন কিংবা কোন যাদুকর নন।
সমকালেও সমালোচকের দৃষ্টিতে কোরআন পড়তে যেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন এমন পাঠকের সংখ্যা কম নয়। এদেরই একজন জোসেফ ইসলাম। এর খঁুত বের করতেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিবষ্টি ছাত্রের মতো নিয়মিত পঠনের পর ক্রমাগত প্রত্যাঘাতে পর্যুদস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি মেনে নিয়েছেন যে, না, ইশ্বর সত্যিই প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছেন, এ কোন মানুষের রচনা নয়।
এ ব্যাপারে ফেসবুক স্ট্যাটাসে কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনার কথা বলেছেন জোসেফ।
কোরআনের কিছু আয়াত তুলে ধরে তিনি প্রশ্ন করেছেন, এগুলি কি সত্যিই একজন মিথ্যা নবীর বাক্য যেখানে তিনি নিজেকেই তিরস্কার করছেন এমন এক জনগোষ্ঠীর সামনে যারা শত্রুভাবাপন্ন এবং তার খুঁত ধরার জন্য মুখিয়ে আছে? তাদের সামনে নিজেকে জাহিল বলে উলে্লখ করবেন তিনি? নাকি এটা না করে তার উপায় ছিল না, কারণ এটা প্রত্যাদেশ।
১. যদি ওদের উপেক্ষা তোমার কাছে কষ্টকর হয় তাহলে পারলে ভূগর্ভে সুরঙ্গ অথবা আকাশে মইয়ের খঁোজ কর এবং ওদের কাছে কোন নিদর্শন আন। আল্লাহ চাইলে তাদের সবাইকে অবশ্যই সত্পথে একত্র করতেন। সুতরাং তুমি মুর্খদের (জাহিল) অন্তভর্ূক্ত হয়ো না। (৬:৩৫)
২. নিজের পথভ্রষ্টতার কথা স্বীকার করার ঝঁুকি নেয়া কি একজন মিথ্যা নবীর জন্য মানানসই নাকি এটাও প্রত্যাদেশ বিধায় প্রকাশ করা অনিবার্য ছিল।
তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন পথভ্রষ্ট অবস্থায়, অতঃপর তিনি পথ দেখালেন। (৯৩:৭)
লক্ষ্য করবেন, একই আরবী শব্দ দাল্লা ব্যবহার করা হয়েছে সুরা ফাতিহার শেষ আয়াতে। (আরও অনেক আয়াতে এর ব্যবহার আছে) প্রতিদিন শত কোটি মুসলিম সালাতে এটি পাঠ করেন। এর অর্থ তাদের ভালোই জানা। এই আয়াতের ক্ষেত্রে অনেকে শব্দটির অর্থকে লঘুভাবে উপস্থাপন করতে চান।
৩. বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থে অনেক বিবরণ মেলে যেটা পড়ে মনে হয় নবীজী শৈশব থেকেই ঈমান নিয়ে বড় হয়েছেন। তিনি জানতেন সত্য পথের নিশানা। কিন্তু কোরআন বলছে, না, নবীজী আগে জানতেন না ঈমান কি জিনিস। নিজে রচনা করলে তার গ্রন্থে এমন স্বীকোরোক্তি কতটা মানানসই কিংবা জরুরী?
এভাবে আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রুহ তথা আমার নির্দেশ। তুমি তো জানতে না কিতাব কী, ঈমান কী।’ (৪২:৫২)
৪. একজন মিথ্যা নবী জাল গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে নিজের দুর্বলতার কথা কি এভাবে জনসমক্ষে বলবেন যা সংরক্ষিত ও বাহিত হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও যাবে।
আমি তোমার কাছে সেরা কাহিনীগুলো বর্ণনা করছি, ওহীর মাধ্যমে তোমার কাছে কোরআন পাঠিয়ে, যদিও এর আগে নিশ্চিতভাবেই তুমি ছিলে উদাসীনদের/অনবহিতদের (গাফিল) অন্তভর্ূক্ত। (১২:৩)
৫. একজন মিথ্যা নবী কি এভাবে তার দুর্বলতা/ধিক্কারকে জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন যেভাবে করা হয়েছে নিচের আয়াতে। নাকি এও এক প্রত্যাদেশ মাত্র।
হে নবী! আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন তা তুমি নিিষদ্ধ করছ কেন? তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাচ্ছ। কিন্তু আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু। (৬৬:১)
কোরআন কীভাবে কার সঙ্গে কথা বলবে তা বলা মুশকিল। দর্শন, বিজ্ঞান এর কাব্য কিংবা গদ্যশৈলী যে কোনকিছুর মাধ্যমেই বিশ্বাসের ভিতটুকু খুঁুজে পেতে পারেন যে কেউ। এর যুক্তিপ্রিজমের যে কোন অঞ্চলের আলোই উপলদ্ধির দুয়ার খুলে দিতে পারে যে কোন পাঠকের।
কোরআনের যে অংশগুলিতে নবীর দুর্বলতা উঠে এসেছে সেখানেই এর অথেনটিসিটির নমুনা খুঁজে পেয়েছেন জোসেফ।
জোসেফের মতে- একজন মিথ্যা নবী, যা তিনি প্রচার করছেন তার ব্যাপারে, সংশয়ের কথা পুনপুন ব্যক্ত করতেন না কখনোই।
তোমার কাছে কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে, এ নিয়ে যেন তোমার মনে কোন সংশয় না থাকে…..(৭:২)
আমি তো মুসাকে কিতাব দিয়াছিলাম, অতএব তুমি তার সাক্ষাত্ সম্পর্কে সন্দেহ করো না, আমি ইহা বনী ইসরাইলের জন্য পথ প্রদর্শক করেছিলাম। (৩২:২৩)
আমি তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে যদি তোমার সন্দেহ থাকে তাহলে তোমার পূর্বের কিতাব যারা পাঠ করে তাদের জিজ্ঞাস করে দেখো; তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমার নিকট অবশ্যই সত্য এসেছে। তুমি কখনো সন্দিগ্ধচিত্তদের অন্তভর্ূক্ত হয়ো না। (১০:৯৪)
অনেক আয়াতে আল্লাহ তাকে সান্তনা দিচ্ছেন, সাহস যোগাচ্ছেন।
নবীকে সান্তনা যোগানো আয়াতের কিছু নমুনা- ৫২:২৯, ৬৮:২-৭, ৪৮:৫০, ৭০:৫-৭, ৭৯:৪২-৪৬, ৮২:২১-২৬, , ৯৩:৩-৮, ৯৪:১-৬, ১০৮:১ ও ৩।
অবিশ্বাসীরা যা বলছে তা সত্য নয়, এই নিশ্চয়তার কথা বহুবার বলা হয়েছে (৫২:২৯, ৬৮:২, ৪, ৯৩:৩, ১০৮:৩), বলা হয়েছে প্রতিশ্রুতির কথা (৬৮:৩, ৯৩:৪-৫, ৯৪:৫-৬), আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে (৯৩:৬-৮, ৯৪:১-৪, ১০৮:১), তার কাজ যে শুধু বার্তা পেৌছে দেওয়া, অন্য ব্যর্থতার দায় তার নয় (৭৯:৪২-৪৬, ৮৮:২১-২৬) এবং ধৈর্য ধরার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে (৬৮:৪৮-৫০, ৭০:৫-৭)।
এই সব সংলাপ একজন মিথ্যা নবী রচনা করছেন এটা মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর, বলেছেন জোসেফ। বিশেষ করে এক ক্ষুদ্ধ জনগোষ্ঠীকে কনভিন্স করা যার গুরুদায়িত্ব, তার নবুয়তের ব্যাপারে তাদের নিশ্চিত করা জরুরী যেখানে, সেখানে এটা মেনে নেওয়া আরও কঠিন।
১৪০০ বছর পর, এখনও অনেক আয়াত, যেমন নিচের আয়াতটি, গভীরভাবে পড়লে এর অনুনাদ বিশ্বস্ত পাঠকের অন্তরেও কাপুনি ধরিয়ে দিতে পারে।
আমি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে যদি তোমার সন্দেহ থাকে তবে তোমার পূর্বের কিতাব যারা পাঠ করে তাদের জিজ্ঞাসা কর; তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে সত্য অবশ্যই তোমার কাছে এসেছে। তুমি কখনো সংশয়ীদের অন্তভর্ূক্ত হয়ো না। এবং যারা আল্লাহর নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছে তুমি কখনো তাদের অন্তভর্ূক্ত হয়ো না। তাহলে তুমিও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তভর্ূক্ত হবে। (১০:৯৪)
স্মর্তব্য, এই আয়াত নাজিল হয়েছিল নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর। একজন জাল নবী কি নিজের বিশ্বাস নিয়ে এমন আয়াত রচনা করতে পারেন? নাকি এটা তারই রচনা যিনি জেনেশুনেই পরবর্তীকালের অনেক সমালোচকেরও জিজ্ঞাসারও জবাব এতে রেখে দিয়েছেন।
কোরআনের অথেনটিসিটি নিয়ে অনেকের মনেই অনেক সন্দেহ আছে। এটি কার রচনা? কীভাবে সংগৃহীত হলো? কিছু খোয়া যায়নিতো? কিংবা কিছু ঢুকে পড়েছে নাকি? ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে কোরআনের নিবষ্টি পাঠকের জন্য এটা খুব জরুরী নয় যে এই বই কোথা থেকে এসেছে। যে বই এখন আমাদের সামনে আছে তার ভিতরের যুক্তি পরম্পরা ও বহুস্তর জ্ঞানের ঢেউই এর ঐশ্বরিক প্রেরণায় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথষ্টে।
(জোসেফ ইসলামের স্ট্যাটাস অবলম্বনে)