অর্থ জেনে হোক বা না জেনে হোক, অধিকাংশ মুসলিম সাহাবীদের নাম নেয়ার পর রাজিআল্লাহু আনহু টার্মটি ব্যবহার করেন। ধারণা করা হয় এই টার্মটির অর্থ ‘আল্লাহ তার উপর রাজি/সন্তুষ্ট হউন’। কিন্তু কোরআনে ‘রাজিআল্লাহু আনহুম’ যে অর্থে ব্যবহূত হয়েছে তা বিবেচনায় নিলে রাজিআল্লাহু আনহুর অর্থ হয়, ‘আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট’।
৯৮:৮ তাহাদের প্রতিপালকের নিকট আছে তাহাদের পুরস্কার- স্থায়ী জান্নাত, যাহার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তাহারা চিরস্থায়ী হইবে। আল্লাহ তাহাদের প্রতি সন্তুষ্ট (আরবী রাদিআল্লাহু আনহুম) এবং তাহারাও তাঁহাতে সন্তুষ্ট। ইহা তাহার জন্য, যে তাহার প্রতিপালককে ভয় করে।
৫৮:২২ ..তিনি ইহাদেরকে দাখিল করিবেন জান্নাতে যাহার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে ইহারা স্থায়ী হইবে; আল্লাহ ইহাদের প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছেন (আরবী রাদিআল্লাহু আনহুম) এবং ইহারাও তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট, ইহারাই আল্লাহর দল। জানিয়া রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হইবে।
আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হউন এবং আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট- এ দুটির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। ‘রাজিআল্লাহু আনহু/আনহা’ বলার মাধ্যমে নবীর স্ত্রী-পরিবার-পরিজন, সাহাবীদের ব্যাপারে ঢালাওভাবে অটোমেটিক্যালি ‘আল্লাহ সন্তুষ্ট’ সিদ্ধান্তটি প্রয়োগ করা হয়। কোরআনে এরকম সিদ্ধান্তের পক্ষে কোন নিশ্চয়তা নেই। আল্লাহ কার প্রতি সন্তুষ্ট, তার জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছেই আছে।
সকল নবী ও রাসুলদের জন্য আল্লাহর শান্তি ও আশীর্বাদ কোরআন সমর্থিত (৩৩:৫৬, ৩৭:১০৮-১১১, ৩৭:৭৮-৮০, ৩৭:১১৯-১২২, ৩৭:১২৯-১৩২, ৩৭:১৮১)। কিন্তু স্রেফ নবীর পরিবারভুক্ত হওয়ার কারণে লুত (সাঃ) এর স্ত্রী কিংবা নুহ (সাঃ) এর ছেলেও শাস্তি এড়াতে পারেননি। সেরকম কোন নিশ্চয়তা নবীজীর (সাঃ) পরিবার পরিজন বা কোন সাহাবীর ক্ষেত্রে রয়েছে, এমনটা কোরআনে কোথাও নেই। এ ধরনের নিশ্চয়তাসূচক অভিব্যক্তি কোরআন অনুমোদন করে না। এসব বাগধারার উদ্ভব কোরআন নাজিল ও নবীর তিরোধানের অনেক পরে।
কোরআনের ৩৩:৪৩ আয়াতে সকল মুমিনদের প্রতি আশীর্বাদ প্রেরণের যে কথা বলা হয়েছে সেটি একটি সাধারণ বিবৃতি বা জেনেরিক স্টেটমেন্ট। এখানে কোন সাহাবীর নাম উল্লেখ করা হয়নি। অনেক মুসলিম পন্ডিত রাজিআল্লাহু আনহু বাগধারার সমর্থনে নিচের আয়াতটিও ব্যবহার করা হয়।
৪৮:১৮ আল্লাহ তো মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হইলেন (আরবী রাদিআল্লাহু আনিল মু’মিনীন) যখন তাহারা বৃক্ষতলে তোমার নিকট বায়াত গ্রহণ করিল, তাহাদের অন্তরে যাহা ছিল তাহা তিনি অবগত ছিলেন; তাহাদেরকে তিনি দান করিলেন প্রশান্তি এবং তাহাদেরকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়।
প্রথমত, যারা বায়ত নিয়েছিলেন এখানে তাদের নামের উল্লেখ নেই। তাছাড়া ৪৮:১৬-১৭ আয়াত থেকে জানি সব ইমানদার সাহাবীরা সেখানে ছিলেন না। তাদের চিরন্তন পুরস্কারের বা চিরন্তন সন্তুষ্টির কথা বলা নাই, নিকটবর্তী বিজয়টাকেই পুরস্কার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তদুপরি এই বিজয়ীরা সামনের দিনগুলোতেও সরল পথে থাকবেন কি না সেটা নিশ্চিত নয়। ৪৮:১০ আয়াত থেকে বোঝা যায় এদের মধ্যে পরে কেউ কেউ শপথ ভঙ্গও করে থাকবেন।
৪৮:১০ যাহারা তোমার হাতে বায়াত করে তাহারা তো আল্লাহরই হাতে বায়াত করে। আল্লাহর হাত তাহাদের হাতের উপর। অতঃপর যে উহা ভঙ্গ করে, উহা ভঙ্গ করিবার পরিণাম তাহারই এবং যে আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করে তিনি অবশ্যই তাহাকে মহাপুরস্কার দিবেন।
এটাও প্রণিধানযোগ্য যে, নবীজীর (সাঃ) পক্ষেও বোঝা সম্ভব ছিল না কে ভালো কে মন্দ, যদি না আল্লাহ তাকে জানাতেন।
৯:১০১ মরুবাসীদের মধ্যে যাহারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাহাদের কেহ কেহ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীর মধ্যেও কেহ কেহ, উহারা কপটতায় সিদ্ধ। তুমি উহাদেরকে জান না; আমি উহাদেরকে জানি।
নবী মারা যাওয়ার পর মুুমিনরা বা সাহাবীরা কে কিরকম আচরণ করবে তাও নিশ্চিত ছিল না।
৩:১৪৪ মুহাম্মদ একজন রাসুল মাত্র; তাহার পূর্বে বহু রাসুল গত হইয়াছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিবে? এবং কেহ পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিলে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করিতে পারিবে না; বরং আল্লাহ শিঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করিবেন।
ফলে ৪৮:১৮ এর মতো আয়াতের রেফারেন্স টেনে সকল সাহাবীদের ঢালাওভাবে পুতপবিত্র মনে করা বা তাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট বলা কোরআনের দৃষ্টিকোন থেকে সঠিক নয়। বিশেষ করে কোরআনে বিভিন্ন আয়াতেই আমরা যখন তাদের সমালোচনা দেখি। হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে ঘৃণিত অপবাদ প্রচারেও কুণ্ঠিত হয়নি সাহাবীদের কেউ কেউ। হাদিসের বইগুলোতেও তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই মিথ্যাচার, জেনাসহ নানারকম অপরাধও ও সে কারণে তিরস্কার ও শাস্তির উল্লেখ আছে। নবীজী (সাঃ) মারা যাওয়ার পর যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিলেন অনেকে, নিজেকে নবী বলেও দাবী করেছেন কেউ কেউ। `খোলাফায়ে রাশেদীনে’র আমলেই অন্তঃকোন্দলে সাহাবীদের হাতেই সাহাবীরা এমনকি খলিফারাও নাজেহাল হয়েছেন, নিহত হয়েছেন। পরষ্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার চরম আকার ধারণ করেছিল। অনেক সাহাবীর পক্ষে বিস্তর প্রশংসাসূচক হাদিস থাকলেও এ ব্যাপারে কোরআনের একটি আয়াতই যথেষ্ট।
৫৩:৩২ অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করিও না, তিনিই সম্যক জানেন মুত্তাকী কে? (অংশবিশেষ)
কাজে কাজেই,আল্লাহর নামে কোন কিছু বলার আগে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। যে বিষয়ে আমাদের কোন ধারণা নেই তা আল্লাহর নামে চালিয়ে দেয়া গুরুতর অন্যায়। তবে সাহাবীদের জন্য দোয়া করা যেতে পারে, ক্ষমা চাওয়া যেতে পারে, তাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হউন এ কথাও বলা যায়। কিন্তু আল্লাহ যা বলেননি তা আল্লাহর নামে বলা কি ঠিক?
২:১৬৯ সে (শয়তান) তো কেবল তোমাদের মন্দ ও অশ্লীল কাজের এবং আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা যাহা জান না এমন সব বিষয়ে বলার নির্দেশ দেয়।