বাম হাতে আহার

কোন মজলিসে যখন অনেকের মাঝে কোন একজন বাম হাতে খাবার খায় তাহলে নির্ঘাত কারো বক্রোক্তি বা তীর্যক চাহনির শিকার হতে হয় তাকে। কারণ বংশ পরম্পরায় বিশেষ করে মুসলিম জনমানসে এই ধারণা বাসা বেধে আছে যে, বাম হাতে খাওয়া বা অন্য কোন ভালো কাজ করা যাবে না। বাম হাত শুধু খারাপ কাজের জন্য। যেমন শুচিকর্ম (সেটাই বা খারাপ কাজ হবে কেন?) ইত্যাদি। ঘুষ খাওয়াকেও বাম হাতের কাজ হিসেবে উল্লেখ করার প্রচলন রয়েছে আমাদের সমাজে।

অদ্ভুত এই আচরণ চলে আসছে এবং আমাদের মাধ্যমে আমাদের সন্তানদের মধ্যে এসব কুসংস্কার ছড়িয়ে পরছে। এটাও বেশ জোর দিয়ে বলা হয় যে এটা নবীর সুন্নত।

খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন, কোরআনের আলোকে কেউ কি এই সুন্নতের চর্চার বিষয়টি কখনো যাচাই করে দেখেছেন। (তবে অনেক সময় আবার এ ব্যপারে আমরা চোখ বুজে থাকি, উচ্চবাচ্য করি না। যেমন বামহাতি সেরা ব্যাটসম্যান বা বোলারদের খেলা নিয়ে আজ পর্যন্ত কাউকে সমালোচনা করতে শোনা যায়নি।)
কোরআনে খুব পরিস্কারভাবে বলা আছে কোন কিছু বৈধ কিংবা অবৈধ করার এখতিয়ার একমাত্র আল্লাহর। ধর্মীয় বিধি বিধানের একমাত্র উত্স কোরআন। নবীকে কোন কিছু নিষেধ করার এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। সে এখতিয়ার থাকলে আল্লাহ নবীজীকে এ ধরনের কাজের জন্য ভর্ত্সনা করতেন না।

৬৬:১ হে নবী! আল্লাহ তোমার জন্য যাহা বৈধ করিয়াছেন তাহা তুমি নিষিদ্ধ করিতেছ কেন? তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাহিতেছ; আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

কোরআনের মাধ্যমে সবকিছু বিচার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নবীকে।

৫:৪৮ আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করিয়াছি ইহার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সমর্থক ও সংরক্ষকরুপে। সুতরাং আল্লাহ যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদনুসারে তুমি তাহাদের বিচার নিষ্পত্তি করিও এবং যে সত্য তোমার নিকট আসিয়াছে তাহা ত্যাগ করিয়া তাহাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করিও না। …

৬:১৫৫ এই কিতাব আমি নাযিল করিয়াছি যাহা কল্যানময়। সুতরাং উহার অনুসরণ কর (আরবী ফা-ইত্তাবি’হু) এবং সাবধান হও, তাহা হইলে তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হইবে।

কোরআনের খাবার দাবার সংক্রান্ত অনেক আয়াত আছে। কোন সিদ্ধ কোনটা নিষিদ্ধ; যেমন মৃত পশু, রক্ত, শুকরের মাংস ইত্যাদি খাওয়া যাবে না। এসংক্রান্ত কোন আয়াতে বাম হাত দিয়ে খাওয়া যাবে না এরকম কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। এমনকি সুরা লোকমানে নিজের ছেলেকে যে সকল উপদেশ দিয়েছেন লোকমান, যেমন উচ্চস্বরে কথা না বলা, নম্রভাবে হাটা (‘তুমি পদক্ষেপ করিও সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু করিও’), সেখানেও বাম হাতে না খাওয়ার ব্যাপারে কোন পরামর্শ নেই।

নিজেদের উপর খামাকা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে ইহুদী বা খ্রিস্টানদের বাড়াবাড়ির অনেক উদাহরণ কোরআনে তুলে ধরেছেন আল্লাহ। কিন্তু সেসব বাণী মুসলিমরা হূদয়ঙ্গম করেছে বলে মনে হয় না।

৩:৯৩ তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে ইসরাঈল নিজের জন্য যাহা হারাম করিয়াছিল তাহা ব্যতীত বনী ইসরাইলের জন্য যাবতীয় খাদ্যই হালাল ছিল। বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে তাওরাত আন এবং পাঠ কর।

৩:৯৪ ইহার পরও যাহারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা সৃষ্টি করে তাহারাই যালিম।

৫:৮৭ হে মুমিনগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য উত্কৃষ্ট যেসব বস্তু হালাল করিয়াছেন সেই সমুদয়কে তোমরা হারাম করিও না এবং সীমা লংঘন করিও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীকে পসন্দ করেন না।

খাবারের বৈধ অবৈধ বিষয়ে বিস্তর আয়াত রয়েছে কোরআনে। (৫:৩; ২:১৭৩; ৬:১৪৫: ১৬:১১৫; ৫:৪; ৫:৫; ১৬:১১৮; ৫:১ ইত্যাদি।) এসব আয়াতের কোথাও বাম হাতে খাওয়া যাবে না এরকম কোন কথা নেই।

বাম হাতে খাওয়া নিয়ে সাধারণ কিছু প্রশ্নও মনে আসা স্বাভাবিক:
১. বাম হাতে খাওয়া যদি খাওয়া যদি খারাপ হয় তাহলে প্রার্থনার সময় আমরা ডান হাতের সঙ্গে বামহাতও কেন জুড়ে দিই।
২. রান্না করার সময় যদি দুই হাতই অর্থাত্ বাম হাতও ব্যবহার করি তাহলে খাওয়ার সময় সেটা ব্যবহার করতে দোষ হবে কেন?
৩. বাম হাত দিয়ে কোরআন শরিফ ধরার ক্ষেত্রেও যদি কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকে তাহলে এ হাত দিয়ে খেতে দোষ কোথায়?
৪. বাম হাতি লোকজনদের তো আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। কেন?

তাহলে বাম হাতের খাওয়ার নিষেধাজ্ঞাটা আসলো কোথা থেকে? সহজ উত্তর হাদিস।

জাবির থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তোমরা বাম হাতে খাবে না। কারণ শয়তান বাম হাতে খায়। (মুসলিম শরিফ/ইসলামিক ফাউন্ডেশন/৩৭/পানীয় দ্রব্য/হাদিস নং ৫০৯২)

ইবনু উমার থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: তোমাদের কেউ যখন আহার করে, তখন সে যেন ডান হাতে আহার করে। আর যখন পান করে সে যেন ডান হাতে পান করে। কারণ শয়তান বাম হাতে আহার করে এবং বাম হাতে পান করে। (মুসলিম শরিফ/ইসলামিক ফাউন্ডেশন/ পানীয় দ্রব্য/ হাদিস নং ৫০৯৩)
৫০৯৫ নং হাদিসেও একই কথা বলা হয়েছে। ৫০৯৬ নং হাদিসে আবার এ নিয়ে মোজেজাও তৈরি করা হয়েছে।

সালামা ইবনু আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে বাম হাতে আহার করছিল। তিনি বললেন, তুমি তোমার ডান হাতে খাও। সে বলল, আমি পারবো না। তিনি বললেন, তুমি যেন না-ই পার। অহঙ্কারই তাকে বাধা দিচ্ছে। সালামা বলেন, সে আর তা (তার ডান হাত) মুখের কাছে তুলতে পারেনি। (মুসলিম শরিফ/ইসলামিক ফাউন্ডেশন/ পানীয় দ্রব্য/ হাদিস নং ৫০৯৬)

এসব অবিশ্বাস্য যুক্তিহীন হাদিসের কোন ব্যাখ্যা মেলা ভার। কোরআনে কোথাও বলা হয়নি যে শয়তান মানুষের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ‘প্রাণী’। সে আহার বা পান করে কিংবা তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (অর্থাত্ মানুষের মতো পরিপাকতন্ত্র, রেচনতন্ত্র ইত্যাদি) আছে। বরং বলা আছে শয়তানকে তৈরি করা হয়েছে ধুম্রবিহীন অগ্নি থেকে (৫৫:১৫)।

সুুতরাং মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ধুম্রবিহীন অগ্নি থেকে যাকে তৈরি করা হয়েছে তার বৈশিষ্ট কি মানুষের মতো হবে? নাকি আরব বেদুইনরাই তাদের মধ্যে এই মানবীয় গুন আরোপ করেছে। নরাত্বোরপের এরকম ঘটনা বিশ্বের প্রায় সব ধর্ম-সংস্কৃতিতেই বিদ্যমান। বাস্তবে ডান হাতে খাওয়া বা বাম হাতে খাওয়ার সঙ্গে বিধিবিধানের কোন সম্পর্ক নেই। যার যার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর অধিকাংশ লোক যে ডান হাতে খায় সেটা তাদের বৈশিষ্ট্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top