রাসুলদের মধ্যে কোন পার্থক্য করো না

বিশ্বের মুসলিমদের অধিকাংশের মনে এই বিশ্বাস প্রবল, হুজুরদের নিয়মিত বয়ানের জেরে তা আরো প্রবলতর হয় যে, নবী মোহাম্মদ (সাঃ) রাসুলদের মধ্যে সেরা। অন্য সকল নবী-রাসুলদের তুলনায় তার অবস্থান অনেক উচ্চে। এ কথা তারা বেশ গর্বের সঙ্গে বলেনও বটে।

হতে পারে। তিনিই হয়তো সেরা নবী ও রাসুল। আবার না-ও হতে পারে। কোরআনের কোথাও এই বক্তব্যের পক্ষে কোন বাণী নেই। একেবারেই নেই।

বিতর্কিত হাদিসের গ্রন্থে আছে। এবং আরো অনেক বিতর্কিত হাদিসের মতো এখানেও দেখা যাবে, নবী নিজেকে নিজে শ্রেষ্ঠ বলে বর্ণনা করছেন। এটা যে তার সম্মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সেই বিবেচনা বোধ এরকম হাদিসের নির্মাতা, প্রচারক বা বিশ্বাসীদের কারো মধ্যেই কাজ করে না।

কোরআনে খুব স্পষ্টভাবে রাসুলদের মধ্যে কোন পার্থক্য না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এইসব আয়াত এতই স্পষ্ট, এতই স্ব-ব্যাখ্যাত যে এখানে কোন কিছু ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। এবং আল্লাহর নবী এই নির্দেশনাকে আমলে না নিয়ে নিজেকেই নিজে শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করেছেন, এটা কোনমতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

আরবী শব্দ ফারাক বাংলাতেও বহুল প্রচলিত। ফারাক মানে এক থেকে অন্যকে আলাদা করা। আরবী শব্দ নুফাররিক্বু এর শব্দমূল ফা রা ক্বাফ যার অর্থ আলাদা করা, বৈষম্য করা, বিভেদ করা, পৃথক করা ইত্যাদি। [এডোয়ার্ড লেনের লেক্সিকন, ভলিউম ৬, পৃষ্ঠা ২৩৮৩]

২:১৩৬ তোমরা বল, আমরা আল্লাহতে ঈমান রাখি এবং যাহা আমাদের প্রতি এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হইয়াছে এবং যাহা তাহাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণনকে দেওয়া হইয়াছে। আমরা তাহাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না (আরবী নুফাররিক্বু) এবং আমরা তাঁহারই নিকট আত্মসমর্পণকারী।

২:২৮৫ রাসূল, তাহার প্রতি তাহার প্রতিপালকের পক্ষ হইতে যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে তাহাতে ঈমান আনিয়াছে এবং মুমিনগণও। তাহাদের সকলে আল্লাহে, তাঁহার ফিরিশতাগণে, তাঁহার কিতাবসমূহে এবং তাঁহার রাসুলগণে ঈমান আনয়ন করিয়াছে। তাহারা বলে, আমরা তাঁহার রাসূলগণের মধ্যে কোন তারতম্য করি না (আরবী নুফাররিক্বু), আর তাহারা বলে, আমরা শুনিয়াছি এবং পালন করিয়াছি! হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার ক্ষমা চাই আর প্রত্যাবর্তন তোমারই নিকট।

কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, সত্যিকারের মুমিন কখনো আল্লাহর রাসুলদের মধ্যে পার্থক্য করেন না।

৩:৮৪ বল, আমরা আল্লাহতে এবং আমাদের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছিল এবং যাহা মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাহাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে প্রদান করা হইয়াছে তাহাতে ঈমান আনিয়াছি, আমরা তাহাদের মধ্যে কোন তারতম্য করি না (আরবী নুফাররিক্বু) এবং আমরা তাঁহারই নিকট আত্মসমর্পণকারী।

৪:১৫২ যাহারা আল্লাহ ও তাঁহার রাসুলগণে ঈমান আনে এবং তাহাদের একের সহিত অপরের পার্থক্য করে না (আরবী ইউফাররিক্বু) উহাদিগকে তিনি অবশ্যই পুরস্কার দিবেন এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

এর মানে এই নয় যে, নবী রাসুলদের মর্যাদার তারতম্য নেই। আছে। কিন্তু সেটা আল্লাহর বিচারের বিষয়, বান্দার নয়। একেক রাসুলকে আল্লাহ একেকরকম মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন।

১৭:৫৫ যাহারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে আছে তাহাদিগকে তোমার প্রতিপালক ভালভাবে জানেন। আমি তো নবীগণের কতককে কতকের উপর মর্যাদা দিয়াছি; দাউদকে আমি যাবুর দিয়াছি।

সুরা সাফফাতে আলাদাভাবে বিভিন্ন নবীর উপর শান্তি বর্ষনের কথা বলার পরে উপরোক্ত আয়াতে সকল রাসুলদের প্রতি শান্তি বর্ষণের আশীর্বাণী দিয়েছেন এবং এখানে কোন পার্থক্য করেননি।

৩৭:১৮১ শান্তি বর্ষিত হউক রাসুলদের প্রতি!

কিংবা ধরা যাক নিচের আয়াতটির কথা-

৩৮:৪৫-৪৮ স্মরণ কর, আমার বান্দা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের কথা, উহারা ছিল শক্তিশালী ও সুক্ষদর্শী। আমি তাহাদিগকে অধিকারী করিয়াছিলাম এক বিশেষ গুণের, উহা ছিল পরলোকের স্মরণ। অবশ্যই তাহারা ছিল আমার মনোনীত উত্তম বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত। স্মরণ কর, ইসমাঈল, আল-ইয়াসাআ ও যুল-কিফলের কথা, ইহরা প্রত্যেকেই ছিল সজ্জন।

প্রত্যেক রাসুলকেই আল্লাহ তার জন্য নির্ধারিত মিশন দিয়ে পাঠিয়েছেন। এবং নির্ধারিত দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য তাকে নির্দিষ্ট কিছু গুণাবলী প্রদান করেছেন।

৭:১৪৪ তিনি বলিলেন, হে মূসা! আমি তোমাকে আমার রিসালাত ও বাক্যালাপ দ্বারা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াছি; সুতরাং আমি যাহা দিলাম তাহা গ্রহণ কর এবং কৃতজ্ঞ হও।

কার কী মর্যাদা সেটা আল্লাহ নির্ধারণ করবেন, মুমিনরা নয়
কোরআনের পুনপুন পরিষ্কার নির্দেশনা সত্ত্বেও মুসলিমরা রাসুলদের মধ্যে পার্থক্য রচনা থেকে বিরত তো হয়নি। বরং নিচের আয়াতটিকে পার্থক্য রচনার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে।

২:২৫৩ এই রাসুলগণ, তাহাদের মধ্যে কাহাকেও কাহারও উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াছি। তাহাদের মধ্যে এমন কেহ রহিয়াছে (আরবী মিন-হুম মান কাল্লামা-লহু) যাহার সহিত আল্লাহ কথা বলিয়াছেন, আবারও কাহাকেও উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করিয়াছেন (আরবী দারাজাতিন)। মারইয়াম-তনয় ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করিয়াছি ও পবিত্র আত্মা দ্বারা তাহাকে শক্তিশালী করিয়াছি। আল্লাহ ইচ্ছা করিলে তাহাদের পরবর্তীরা তাহাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ সমাগত হওয়ার পরও পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হইত না; কিন্তু তাহাদের মধ্যে মতভেদ ঘটিল। ফলে কতক ঈমান আনিল এবং কতক কুফরী করিল। আল্লাহ ইচ্ছা করিলে তাহারা পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হইত না; কিন্তু আল্লাহ যাহা ইচ্ছা তাহা করেন।

এ আয়াতে বলা হয়েছে রাসুলদের কারো চেয়ে কারো মর্যাদা বেশি। কিন্তু ইসা (সাঃ) ছাড়া এখানে অন্য কোন নবী রাসুলদের নাম নেওয়া হয়নি। সেই নাম-না-নেওয়া নবী রাসুলদের মধ্যে মোহাম্মদও (সাঃ) আছেন। বলা বাহুল্য, এখানে ইসা (সাঃ) কে যে অন্য সকলের চেয়ে অধিকতর মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছে সে কথাও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তার নামটি নেওয়া হয়েছে একটি উদাহরণ হিসেবে।

উপরের আয়াতে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। আমরা মনে করি আল্লাহ শুধু মুসা (সাঃ) এর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। কিন্তু উপরোক্ত আয়াতে বলা হচ্ছে, তাহাদের মধ্যে এমন অনেকে রহিয়াছে যাহাদের সহিত আল্লাহ কথা বলিয়াছেন।

উপরের অনুবাদটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ থেকে নেওয়া। এখানে আরবী মিন-হুম মান কাল্লামা-লহু : এর অর্থ করা হয়েছে – তাহাদের মধ্যে এমন কেহ রহিয়াছে যাহার সহিত আল্লাহ কথা বলিয়াছেন। অথচ এর প্রায় সকল অনুবাদে রয়েছে – তাহাদের মধ্যে এমন অনেকে রহিয়াছে যাহাদের সহিত আল্লাহ কথা বলিয়াছেন। কয়েকটি অনুবাদ তুলে দেওয়া যাক-

মোহাম্মদ আসাদ: Some of these apostles have We endowed more highly than others: among them were such as were spoken to by God [Himself]
পিকথাল: Of those messengers, some of whom We have caused to excel others, and of whom there are some unto whom Allah spake.
শাকির: We have made some of these messengers to excel the others among them are they to whom Allah spoke
আবদুল হালিম: We favoured some of these messengers above others. God spoke to some;
এ জে আরবেরি : And those Messengers, some We have preferred above others; some there are to whom God spoke.

উল্লেখ্য এখানে তাদের কারো নাম এখানে উল্লেখ করা হয়নি, এমনকি মুসা (সাঃ) এর নামও নয়। কিন্তু এটা থেকে পরিস্কার যে, মুসা (সাঃ) ছাড়াও আল্লাহ অনেক রাসুলের সঙ্গে কথা বলেছেন যাদের নাম বা প্রসঙ্গ কোরআনে আসেনি।

কাজে কাজেই, মোহাম্মদ (সাঃ) কে সকল নবী-রাসুলের শ্রেষ্ঠ বা নবীদের সরদার বলা কিংবা বিভিন্ন অজুহাতে অন্য নবী-রাসুলদের ছোট করে দেখানোর প্রবণতা কোরআনসম্মত নয়। সালাতের দরুদে সকল নবীকে বাদ দিয়ে কেবল দুইজন নবীর উপর দরুদ পড়াটাও পার্থক্য রচনা করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top