সালাতের তিলাওয়াত, নিরবতা ও তাশাহুদ

কোরআনে সালাত সংক্রান্ত আয়াতগুলি পাঠ করে কিছু প্রশ্ন মনে উদয় হওয়া স্বাভাবিক।

সালাতের সুনির্দষ্টি/কঠোর কোন ফর্ম প্রেসক্রাইব করেনি কোরআন। এবং সালাতে কী পড়তে হবে, বা বলতে হবে তাও বিধিবদ্ধ করেনি। যেমন ওজুর বেলায় হয়েছে, যেটি সালাতের পূর্বশর্ত। (৫:৬, ৪:৪৩) কোরআন অনেক বিষয়ে অবশ্য এরকম নিরবতা অবলম্বন করেছে, এবং সেখানে আচারের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, ফ্লেক্সিবল রাখা হয়েছে। আবার অনেক বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছে। যেমন বৈবাহিক সম্পর্ক, তালাক, সম্পত্তি বন্টন, হজের আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদি।
কোরআনে সালাতের নিয়মকানুন সম্পর্কে একেবারে কিছু নেই, তা নয়। বিভিন্ন আয়াতে সালাতের ব্যাপারে কয়েকটি নির্দেশ খুব পরিস্কারভাবে দেওয়া আছে।

সালাতের উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহর স্মরণ (৬:১৬২, ২০:১৪)
ওজু/গোসল/তায়াম্মুম করতে হবে (৪:৪৩, ৫:৬)
কিবলামুখী হতে হবে। (২:১৪৩-৪৪)
সালাত আদায় করতে হবে নির্দষ্টি সময়ে (৪:১০৩)
সালাতের সময় (৪:১০৩, ১১:১১৪, ১৭:৭৮, ২৪:৫৮, ৩০:১৮, ২:২৩৮, ২০:৫৮)
সালাতে দাড়াতে হবে (৩:৩৯,৪:১০২) রুকু ও সিজদা করতে হবে (৪:১০২, ২২:২৬, ৩৮:২৪, ৪৮:২৯)
সালাত সশব্দে এবং বুঝে (৪:৪৩)
সালাতের সময় স্বর মধ্যবর্তী রাখা (১৭:১১০)
জামাতে সালাত আদায় করতে হবে। (৬২:৯)
মসজিদে গেলে সুন্দর পোশাক পরতে হবে। (৭:৩১)
সালাতের ইমাম থাকবে (৪:১০২)
বিপদের সময় সালাত সংক্ষপ্তি করা যাবে (৪:১০১)
জরুরী অবস্থায় হঁেটে বা আরোহী অবস্থায়ও সালাত আদায় করা যাবে (২:২৩৯)
সালাত ও জিকর এক হবে এমন কথা নেই (৬২:১০) জিকর উত্তম (২৯:৪৫)
সালাতকে পরিত্যাগ না করার ব্যাপারে সতর্কতা (১৯:৫৮-৫৯)
সালাতের উদ্দেশ্য পাপ থেকে রক্ষা পাওয়া (২৯:৪৫)

উপরে দেওয়া গাইডলাইনের আলোকেই সালাত আদায় করতে হয়। বর্তমানে আমরা যে ফর্মে সালাত আদায় করি তাতে মূল নির্দেশনার সঙ্গে অসঙ্গতি না থাকলেও কিছু গুরুতর বিচু্যতি আছে বলে আশংকা হয়।

এক.
নিচের আয়াতটি আমরা মনে করি শুধু নেশার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বাক্যের শেষাংশটুকু আমরা লক্ষ করি না।

৪:৪৩ হে মুমিনগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তীও হইও না যতক্ষণ না তোমরা যাহা বল তাহা বুঝিতে পার।

অর্থাত্ সালাতের একটা শর্ত, যা পড়ি তা যেন বুঝে পড়ি। তাই নয় কি? আমরা যদি বুঝতাম আমরা কি পড়ছি হয়তো আমরা পড়ার ব্যাপারে আরো সতর্ক হতাম। না বুঝে পড়ায় অনেক বিভ্রাট হয় যা আমরা উপলদ্ধিও করতে পারি না।
কেউ কেউ বলেন, হয়তো ঠিকই বলেন, সালাত মাতৃভাষায় আদায় করাই উত্তম।

দুই.
সালাতের সময় স্বরক্ষেপন।

১৭:১১০ তোমরা সালাতে স্বর উচ্চ করিও না এবং ক্ষীণ করিও না, এই দুইয়ের মধ্যপথ অবলম্বন কর।

এই আয়াতে কোন অস্পষ্টতা নেই। তবু জোহর আর আসরে আমরা নিরব থাকি কেন? কিংবা মাগরেব ও এশার দ্বিতীয়ার্ধে? নবীজী (সাঃ) কি আল্লাহর নির্দেশ বুঝতে পারেননি। কিংবা দরকার মনে করেছেন কিছু সংশোধনের, যোজন-বিয়োজনের, যার এখতিয়ার তার নেই? (৬৯:৪৪-৪৮)

নবীর কাজ ছিল শুধু বাণী পেৌছে দেওয়া। কোরআনের মাধ্যমে সবাইকে উপদেশ দেওয়া। বিস্তর আয়াতে এ কথা উলে্লখ করা হয়েছে।

আর এই প্রশ্নও মনে জাগে, একটি পরিস্কার নির্দেশ আল্লাহ কেন আংশিকভাবে দেবেন। যেখানে তিনি বলছেন, আমার কখনো শব্দের অভাব হয় না। (৩১:২৭)

কিছু সালাতে ইমাম যে নিরবে কোরআন পড়েন তার অর্থ কী থাকে, যদি কেউ শুনতে না পান। পিছনে যারা আছেন তারা কি চুপ করে থাকবেন? তাদের ইচ্ছামতো সুরা পড়বেন? অথবা অন্য কিছু ভাববেন? কী ভাববেন? এটা কি একধরনের বিশৃংখলা তৈরি করে না?

তিন.
নিচের আয়াত দুটিতেও খুব পরিস্কারভাবে বলা আছে-

৬:১৬২ বল, আমার সালাত আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমুহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে।

২০:১৪ আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর।

কিন্তু আমরা সালাতের সময় তাশাহুদে নবীকে সালাম দিই এমনভাবে যেন তিনি আমাদের সামনে আছেন। (আসসালামু আলাইকা ইয়া আইয়ুহান্নবীউ এর পরিস্কার অর্থ : হে নবী! আপনাকে সালাম)। অথচ আমরা নামাজ পড়ি আল্লাহর স্মরণার্থে!
তাশাহুদের পর আমরা দরুদ পড়ি হযরত ইব্রাহিম (সাঃ) ও হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর জন্য। কারণ কি এই যে, এই দুজনকেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ নবী মনে করি। নাকি আমাদের উচিত সকল নবীর জন্য দোয়া প্রার্থনা করা? কোরআনে খুব পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, আমরা যেন কোন নবীর মধ্যে পার্থক্য না করি।

২: ১৩৬
আমরা তাহাদের (নবী/রাসুলদের) মধ্যে কোন পার্থক্য করি না।
২:২৮৫
তাহারা (মুমিনগণ) বলে, আমরা তঁাহার রাসুলগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না।
৩:৮৪
আমরা তাহাদের (নবীদের) মধ্যে কোন তারতম্য করি না।
৪:১৫২
যাহারা আল্লাহ ও তঁাহার রাসুলগণে ঈমান আনে এবং তাহাদের একের সঙ্গে অপরের পার্থক্য করে না উহাদেরকে তিনি অবশ্যই পুরস্কার দিবেন।

আমরা বরং সকল রাসুলের প্রতি দরুদ পড়তে পারি যার উলে্লখ আছে ৩৭:১৮১ আয়াতে।

৩৭:১৮১ শানি্ত বর্ষিত হউক সকল রাসুলদের প্রতি।

একটু চিন্তা করলেই প্রশ্ন জাগবে, নবীজী (সাঃ) যখন নামাজ পড়তেন তিনি কি নিজের প্রতি নিজে সালাম দিতেন, বলতেন, হে নবী আপনাকে সালাম? দরুদ পড়তেন নিজের উপর? এটা কি বাস্তবসম্মত।

ধর্মীয় বিষয়ে নতুন কিছু আবিস্কার করা তো তার এখতিয়ার বহির্ভূত ছিল। আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রচার করা, কোরআনের মাধ্যমে মানুষকে পরিচালিত করা ছিল তার একমাত্র কাজ একথা বহুবার বহু আয়াতে উলে্লখ করা হয়েছে। যদি তিনি এর অন্যথা করতেন তাহলে কী হতো সে বিষয়েও একাধিক সতর্কবাণী আছে।

৬৯:৪৪-৪৮
সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করিয়া চালাইতে চষ্টো করিত, আমি অবশ্যই তাহার দক্ষিণ হস্ত ধরিয়া ফেলিতাম, এবং কাটিয়া দিতাম তঁাহার জীবন-ধমনী, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেহই নাই যে তাহাকে রক্ষা করিতে পারে।
(এছাড়াও দেখুন ৬:১১৪, ৬৮:৩৬-৩৮ ইত্যাদি)

অনেকে বলেন, কোরআনে সব নেই। হাদিসে বিস্তারিত আছে।
অথচ কোরআনকে আল্লাহ বলেছেন বিস্তারিত, (৪১:৩, ১১:১) সবকিছুর পরিস্কার ব্যাখ্যা (১৬:৮৯, ৩১:২৭), চূড়ান্ত মাপকাঠি/মানদন্ড (৪২:১৭, ৫৭:২৫) পরিস্কার প্রমাণ (২০:১৩৩, ৬:১৫৭)।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে শত সহস্র হাদিসের মধ্যে একটি হাদিসও আপনি পাবেন না যেখানে সালাতের পূর্ণ বিবরণ আছে। বুখারি শরিফের সালাত চ্যাপ্টারে গিয়ে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। বিভিন্ন হাদিসের কারণে মুসলিমদের একেক দল একেকভাবে নামাজ পড়ে। কেউ হাত বুকের উপর , কেউ নাভির উপর, কেউ হাত ছেড়ে নামাজ পড়ে। আরও অনেক পার্থক্য আছে। এসবে আসলে কোন সমস্যা নেই। কোরআনের মূল শর্ত পূরণ হলে সকলেরই সালাত আদায় ঠিক আছে বলে মনে করি। এ নিয়ে লাঠালাঠি করারও কিছু নেই।

তাছাড়া প্রশ্ন জাগে, এক আল্লাহ দ্বৈত-প্রত্যাদেশ কেন পাঠাবেন? তাহলে কি, কোরআন অসম্পূর্ন একটি কিতাব? এটাকে সাপোর্ট করার জন্যই নবীর মৃতু্যর ২০০ বছর পর সহায়ক গ্রন্থের দরকার হলো?
অথচ ৬:১৫৫ আয়াতে আল্লাহ বলছেন :

এই কিতাব আমি নাজিল করিয়াছি যাহা কল্যানময়। তোমরা উহার অনুসরণ কর এবং সাবধান হও, তাহা হইলে তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হইবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top