বিখ্যাত হাদিসের বইগুলোতে যে ক্রটিপূর্ণ হাদিস রয়েছে এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। গত হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে অনেক আলেমই জাল ও ক্রটিপূর্ণ হাদিসের নমুনা হাজির করেছেন। ইবনে জাওজীর আল মাউজুয়াত্ (ইংরেজি নাম A Great Collection of Fabricated Traditions) ছাড়াও এ বাবদে বিস্তর বই লেখা হয়েছে। ইবনুল কাইয়ূম, ইবনে হাজর সহ প্রখ্যাত অনেক ইমাম এ ধরণের জাল হাদিস নির্ণয়ের কিছু নিয়মনীতিও তৈরি করেছিলেন (দেখুন মোহাম্মদ আকরাম খাঁ রচিত মোস্তফা চরিত, উপক্রমনিকার দশম পরিচ্ছেদের জাল হাদিছের লক্ষন পর্ব। এছাড়াও বিশেষভাবে পাঠ্য পঞ্চম থেকে দশম পরিচ্ছদও)। কিন্তু তত্সত্ত্বেও সেসব হাদিস বাদ দিয়ে পরবর্তী সংস্করণ করার কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি কোথাও। কেন? এ তো ঐশ্বরিক গ্রন্থ নয়। মানবরচিত গ্রন্থ, ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে। সংশোধনে দোষ কোথায়? বুখারি নিজেই তো তার সংগ্রহের শতকরা ৯৯ ভাগ হাদিস ছেঁটে ফেলেছিলেন সম্পাদনার কাঁচিতে। অন্য কেউ তার বইটি অধিকতর পরিমার্জনা করতে পারবেন না, এমন কোন দিব্যি কি তিনি দিয়েছেন? দিলেই বা আমরা সেটা মানব কেন?
যে ছয়টি হাদিসের বই প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে বুখারি ও মুসলিমের বই দুটি রেফারেন্স হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয়। এখানে শুধুমাত্র বুখারি শরিফেরই কয়েকটি পরষ্পরবিরোধী হাদিসের উদাহরণ দেয়া হলো যা কোন সহীহ বইয়ের লক্ষণ নয়। এরকম আরো বিস্তর হাদিস রয়েছে যেগুলি শুধু পরষ্পরবিরোধী নয়, কোরআনের সরাসরি নির্দেশ/নির্দেশনার বিপরীত। এসব পরষ্পরবিরোধী হাদিসগুলো থেকে একটি রেখে অন্যটি অথবা দুটোই বাদ দেয়া যায়। অন্যথায় এসব হাদিসের দুটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। কোরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হাদিসগুলি অবশ্যই বর্জন করা উচিত।
১. নবীজী (সাঃ) মক্কা ও মদিনায় কত বছর ছিলেন?
মক্কা ১০ বছর মদিনায় ১০ বছর: বুখারি শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ষষ্ঠ খন্ড আম্বিয়া কিরাম অধ্যায় ৩২৯৫ ও ৩২৯৬ নং
মক্কা ১৩ বছর, মদিনা ১০ বছর: বুখারি শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ষষ্ঠ খন্ড আম্বিয়া কিরাম অধ্যায় ৩২৮৪, ৩৬২২ ও ৩৬২৩
২. কোরআনের শেষ আয়াত হিসেবে নাজিল হয় কোনটি?
সুদের আয়াত : সপ্তম খন্ড তফসির অধ্যায় ৪১৮৮
৪:১৭৬ আয়াত (সুদের কথা নেই): সপ্তম খন্ড তফসির অধ্যায় ৪২৯৮
৩. দাজ্জাল কি নবীর সমসাময়িক না পরের?
পরের : তৃতীয় খন্ড হজ্জ অধ্যায় ১৭৫৮, ১৭৫৯, ১৭৬০, ১৭৬১
সমসাময়িক : দশম খন্ড কুরআন ও সুন্নাহ অধ্যায় ৬৮৫৩
৪. আসরের পর ২ রাকাত সুন্নত নামাজ পড়া সম্পর্কে।
পড়া উচিত : দ্বিতীয় খন্ড সালাতের ওয়াক্তসমূহ ৫৬৩, ৫৬৪, ৫৬৫, ৫৬৬
পড়া নিষেধ : দ্বিতীয় খন্ড সালাতের ওয়াক্তসমূহ ৫৬০, ৫৬১, ৫৫৯
৫. হযরত সুলায়মানের (সাঃ) স্ত্রীসংখ্যা কত ছিল?
১০০ জন : অষ্টম খন্ড বিয়ে শাদী অধ্যায় ৪৮৬২
৯০ জন : দশম খন্ড, শপথ ও মানত অধ্যায় ৬১৮৪
৬০ জন : দশম খন্ড তাওহীদ প্রসঙ্গ অধ্যায় ৬৯৬১
৬. নবীর জীবত্কালে কোরআনের ৪ সংগ্রহকারীর তালিকা?
তালিকায় আবু দারদা নেই: ষষ্ঠ খন্ড আম্বিয়া কিরাম অধ্যায় ৩৫৩৮,৩৫৩৪ অষ্টম খন্ড ফাযায়িলুল কোরআন অধ্যায় ৪৬৩৭
তালিকায় উবাই বিন কাব নেই : অষ্টম খন্ড ফাযায়িলুল কোরআন অধ্যায় ৪৬৩৮
৭. হযরত ঈসার (সাঃ) গায়ের রং
লালচে সাদা/ ধুসর : দশম খন্ড ফিতনা অধ্যায় ৬৬৪৩, ৬৫৫৩
সাদাটে লাল/গৌর বর্ণ: দশম খন্ড , স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান অধ্যায় ৬৫২৮, ষষ্ঠ খন্ড ৩১৯৫, ৩১৯৬
মডারেট : পঞ্চম খন্ড সৃষ্টির সূচনা অধ্যায় ৩০১২
বাদামী : ষষ্ঠ খন্ড আম্বিয়া কিরাম অধ্যায় ৩১৯৭, ৩১৯৮
সাদাটে বাদামী/গেরুয়া : নবম খন্ড পোশাক পরিচ্ছদ অধ্যায় ৫৪৮১
৮. খারাপ লক্ষণ বা অশুভ ইঙ্গিত ইত্যাদিতে বিশ্বাস
নিষিদ্ধ : নবম খন্ড চিকিত্সা অধ্যায় ৫৩০০, দশম খন্ড ৬০২৮, ৬০৯৮
সিদ্ধ: অষ্টম খন্ড বিয়েশাদী অধ্যায় ৪৭২২, ৪৭২৩, পঞ্চম খন্ড জিহাদ অধ্যায় ২৬৬১
৯. ওজুতে নবীজী (সাঃ)
একবার করে হাত মুখ পা ধুয়েছিলেন: ১ম খন্ড ওজু অধ্যায় ১৪২, ১৫৯।
দুইবার করে ধুয়েছেন: ১ম খন্ড ওজু অধ্যায় ২৬০
তিনবার করে ধুয়েছেন: ১ম খন্ড ওজু অধ্যায় ১৯০
১০. কিয়ামত কবে হবে? যতক্ষন
দাওস গোত্রীয় রমণীদের নিতম্ব দোলায়িত না হবে: দশম খন্ড ফিতনা অধ্যায় ৬৬৩১
কাহতান গোত্র থেকে এক লোক বের হয়ে মানুষকে লাঠি নিয়ে তাড়িয়ে না দেবে: দশম খন্ড ফিতনা অধ্যায় ৬৬৩২
হিযাজের আগুনের আলোয় বসরার উটের গর্দান আলোকিত হবে: দশম খন্ড ফিতনা অধ্যায় ৬৬৩৩
যতক্ষণ না একজন আরেকজনের কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলবে হায় আমি যদি তার স্থলে থাকতাম দশম খন্ড ফিতনা অধ্যায় ৬৬৩০
১১. কুকুর সম্পর্কিত
কুকুর মেরে ফেলতে হবে, ঘরে যাতায়াত নিষিদ্ধ: পঞ্চম খন্ড সৃষ্টর সূচনা অধ্যায় ৩০৮০, ৩০৮১, ৩০৮৮, ৩০৮৯ ৩০৯০
কুকুরকে পানি খাওয়ালে ইশ্বরের ক্ষমা: পঞ্চম খন্ড সৃষ্টর সূচনা অধ্যায় ৩০৮৭
মসজিদেও কুকুরের অবাধ যাতায়াত: প্রথম খন্ড ওজু অধ্যায় ১৭৪
এরকম পরষ্পর বিরোধী বিস্তর হাদিস ছড়িয়ে আছে বুখারিসহ বিভিন্ন হাদিসের বইগুলোতে। আছে কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক হাদিস। আছে এমন হাদিস যা আল্লাহর মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে। নবীজী (সাঃ) এবং মুসলিমদের জন্যও অপমানজনক হাদিস আছে বিস্তর। কিছু কিছু হাদিস যে কোন স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্য দুর্বোধ্যও বটে। এসব বিভ্রান্তিকর হাদিসগুলি অপসারণ করে বুখারি বা অন্য হাদিসের বইগুলি প্রকাশিত হলে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তো বই কমতো না। কিন্তু কী কারণে এই জরুরী কাজটা করা হচ্ছে না সেটা বোধগম্য নয়।
