সর্বশক্তিমান পরম সত্তাকে একাধিক নাম দিয়ে বিশেষায়িত করা যায় কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু নাম দিয়ে তাকে সীমায়িত করা তার মহিমার জন্য শোভনীয় নয়, উচিত নয়। কিন্তু একে সীমায়িত করা হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে একটা নির্দ্দিষ্ট নামাবলী- আল্লাহর ৯৯ নাম।
অথচ সকল সুন্দর নামই আল্লাহর- কোরআনে এ কথা একাধিকবার বলাও হয়েছে।
১৭:১১০ বলুন, আল্লাহ বলে আহ্বান কর কিংবা রহমান বলে, যে নামেই আহ্বান কর না কেন, সব সুন্দর নাম তাঁরই।
৭:১৮০ সব সুন্দর নামই আল্লাহর। কাজেই সেসব নামে তাকে আহ্বান করো।
৫৯:২৪ …সব সুন্দর নামই তাহার।.. (অংশবিশেষ)
১.
যে হাদিসের বরাতে ৯৯ টি নামের মাহাত্ম্য জারি আছে সেটি এসেছে মূলত আবু হোরায়রার কাছ থেকে।
হাদিসটি এরকম:
আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহতালার ৯৯ – এক কম একশটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এ নামগুলো মুখস্ত করবে সে জান্নাতে যাবে।
(বুখারি, ৯:৯৩:৪৮৯, ৮:৭৫:৪১৯ সহীহ মুসলিম ২৬৭৭, ৬৪৭৫ ইসলামিক ফাউন্ডেশন দশম খন্ড নং ২৬৮১ ও ৬৮৮৮)
(এরকম শর্টকাটে জান্নাতে যাওয়ার বিস্তর ব্যবস্থা রয়েছে হাদিসের বইগুলোতে!)
তিরমিজি ইবনে মাজাহসহ আরো অনেকে এই হাদিস রেকর্ড করেছিলেন। তিরমিজির কেতাবে শুয়াইব ইবনে আবি হামজার বরাতে আল ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম ৯৯টি নামের তালিকা দেন। তবে মুহাদ্দিসদের মধ্যে অনেকেই একে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নামগুলো যে পরে যোগ করা এ ব্যাপারে প্রায় সকলেই একমত। একে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন তিরমিজি, বায়হাকী, ইবনে হাজম, আল দাউদি, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাছির, ইবনে হাজর, আল আলবানি প্রমুখ। মুহাদ্দিসদের অনুমান, আল ওয়ালিদ তার শিক্ষকদের কাছ থেকে নামের এই তালিকা পেয়ে থাকবেন। তবে নামগুলো বাদে যে হাদিস আছে সেগুলিকে অধিকাংশ মোহাদ্দেসই সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ওই নামগুলোই নামাবলী হিসেবে পাঠ করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এই হাদিসের পাশাপাশি অন্যরকম হাদিসও আছে। যেমন আহমদ কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিস যেটিকে আস সিলসিলা (১৯৯) গ্রন্থে আল আলবানি সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ থেকেও এই হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (মুসনাদ ১/৩৯১)
‘আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ কর্তৃক বর্ণিত যে, নবী (সাঃ) বলেছেন, যখন কেউ দুর্দশায় পতিত হবে সে যেন প্রার্থনা করে, হে আল্লাহ! আমি তোমার দাস এবং তোমাদের দাসের ছেলে এবং তোমার দাসীর ছেলে, আমার জীবন তোমার হাতে, আমার জীবন তোমার ইচ্ছামতো চলে, তুমি যেভাবে চাও সেভাবে, আমি তোমার সব নামে যা তুমি শিখিয়েছো, তোমার কিতাবে উল্লেখ করেছো বা যা তুমি গুপ্ত রেখেছো সকল নামে তোমাকে আহ্বান করছি।’
ইমাম আহমদ (মুসনাদ), আল হাইতামি (মজমা আয জাওয়াইদ), আল হাকিম (মুস্তাদরাক), ইবনে আবি সাইয়্যিবা (মুসনাদ), তাবারানি (আল কবীর), বায়হাকি এবং আরো অনেকে তাদের গ্রন্থে হাদিসটি সংকলিত করেছেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়াও ৯৯ নামের হাদিসটি স্বীকার করে নিয়েও এ কথা বলেন যে, ‘এর মানে এই নয় যে আল্লাহর ৯৯টি নামই রয়েছে। মুসলিম পন্ডিতদের অধিকাংশই মনে করেন যে আল্লাহর নাম ৯৯টিরও বেশি।’
২.
বেশি যে সেটা সামান্য মনোযোগে কোরআন পাঠ করলে যে কেউ বুঝবেন। যেমন কোরআনে সুরা ফাতিহা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুরায় বহুবার আল্লাহর রব নামটি এসেছে। এমনকি প্রার্থনাসূচক আয়াতগুলিতে তাকে রব বলেই উল্লেখ করা হয়েছে- হে আমার রব (রাব্বি) বা হে আমাদের রব (রাব্বানা)। ইব্রাহিম(সাঃ) যখন প্রভুকে ডেকেছিলেন তখন রব নামেই ডেকেছিলেন। (২:২৬০) অথচ অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, তালিকায় এই নামটিই নেই।
তালিকায় কোরআনে উল্লেখিত আল্লাহর অনেক নাম সরাসরি নেওয়া হয়েছে। যেমন আর রাহমান, আর রাহিম, আল গফুর ইত্যাদি। আবার তালিকার অনেক নাম তৈরি করা হয়েছে ক্রিয়াপদ অনুসরণ করে। যেমন ক্বাবিদ, সাবিত এবং এরকম আরো অনেক নাম। কোরআনে কোথাও আল্লাহু ক্বাবিদ কিংবা আল্লাহু সাবিত বলা হয়নি। কিন্তু সুরা বাকারার ২৪৫ এবং এরকম আরো কিছু আয়াতে উল্লেখিত ক্রিয়াপদ থেকে নাম দুটি নেয়া হয়েছে। ওই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহই সংকুচিত করেন (ইয়াক্ববিদু) এবং তিনিই প্রসস্ততা দান করেন (ইয়াবসুত্তু)। এ থেকে তালিকায় যুক্ত হয়েছে আল্লাহু ক্বাবিদ, আল্লাহু সাবিত। অথচ একই যুক্তি অনুসরণ করে আরো অনেক নাম তালিকায় নেয়া যেতো, কিন্তু নেওয়া হয়নি। যেমন শাফি। সুরা তওবার ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ মুসলমানদের অন্তরসমুহ শান্ত (ইয়াশফি) করবেন।’ সুরা আস শুয়ারার ৮০ নম্বর আয়াতে ইব্রাহিম (সাঃ) বলছেন, ‘যখন আমি রোগাক্রান্ত হই তখন তিনিই আরোগ্য দান করেন (ইয়াশফিনি)।’ ইত্যাদি। ফলে এখানে সহজেই আল্লাহ পরম উপশমকারী হিসেবে আল্লাহু আশ শাফি নামটি আসতে পারতো। আবার সুরা নাহলের ৯১ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করার পর সে অঙ্গীকার পূর্ণ কর এবং পাকাপাকি কসম করার পর তা ভঙ্গ করো না, অথচ তোমরা আল্লাহকে জামিন (কাফিলান) করেছো। তোমরা যা কর আল্লাহ তা জানেন।’ এখানেও আল্লাহর একটি নাম আসে, তিনি সর্বোচ্চ জামিনদার- আল কাফিল।
ওয়া-লাম ইয়া শব্দমূল থেকে দুটি নাম ৯৯ নামের তালিকায় আছে। (আল ওয়ালি -বন্ধু ৩:৬৮, ও অভিভাবক ৪২:৯)। কিন্তু ২:২৮৬, ৯:৫১ ও ২২:৭৮ আয়াতে একই শব্দমূলের অন্য ভ্যারিয়েশনও দেখা যাচ্ছে। মাওলি, যার অর্থ যিনি পরিবর্তন ঘটান, রক্ষাকর্তা, পথপ্রদর্শক। ফলে তালিকায় আল মাওলি নামটিও নেয়া যেতে পারে। কিংবা ধরুন, আল নাসির। এর শব্দমূল নুন সোয়াদ রা যার অর্থ সাহায্য, সাহায্যকারী, একটি নদীর উপনদী, উপদেষ্টা। সুরা ফাতিহাতে বলা হচ্ছে, একমাত্র আপনার কাছেই আমরা সাহায্য চাই। সুরা বাকারার ২৮৬ আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘সুতরাং আমাদের কাফেরদের উপরে বিজয়ী হতে সাহায্য করুন।’ কিংবা সুরা হজ্জ এর ৭৮ আয়াতে রয়েছে, ‘এবং তিনি কত উত্তম সাহায্যকারী।’
সুতরাং আল নাসির নামটি বাদ দেওয়ার কোন কারণ নেই। একইভাবে সুরা আর রুমের ৩০ নম্বর আয়াত অনুসারে আল ফাতির নামটিও নেওয়া যায়।
একইভাবে আসতে পারে আল জামিল, আল তায়্যিব, আল বিতর, আল মান্নান, আল সুব্বুহ, আল মুস্তান, আল কাফিল, আল ওয়াফি, আল ওয়াক্বি, আল মুনসি, জুলফাজিল আযীম ইত্যাদি নাম। কার্যত এসবকে আল্লাহর নাম বিবেচনা করে মুসলমানরা সন্তানদের নামকরণও করে থাকে। যেমন আবদুল মান্নান। কিন্তু তালিকায় এসব নাম নেই। কেন? কোন জবাব নেই।
আরেকটি ব্যাপার খটমটে লাগে। ৯৯ নামের তালিকায় এমন অনেক নাম আছে যেগুলি ক্রিয়াপদ অনুসরণ করে আল্লাহর গুণবাচক নাম হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তা নেতিবাচক। যেমন যেহেতু তিনি প্রতিশোধ গ্রহণে সক্ষম, তাই তার নাম আল মুনতাক্বিম, প্রতিশোধগ্রহণকারী। আছে আদ-দার নামটি যার অর্থ যে ক্ষতিকর। আল মুঝিল মানে অপমানকারী। এসব নাম ধরে তাকে আহ্বান করা কতটা যুক্তিসঙ্গত তা বোধগম্য নয়।
৩.
প্রকৃতপক্ষে আমাদের কল্যান কামনায় তাকে যে নামেই ডাকি – মুলত কায়োমনোবাক্যে সেই পরম একককেই আহ্বান করি যার উপাসনা আমরা করি। অপার মহিমায় তিনি জগত্ সংসার সৃষ্টি করেছেন এবং একদিন আমাদেরকে তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। এই সর্বশক্তিমানকে ৯৯ নাম দিয়েও সীমায়িত করা যায় না। এক বা একাধিক নাম দিয়ে তাকে বিশেষায়িত করা যায় কিন্তু সীমায়িত করা তার মহিমার জন্য শোভনীয় নয়। যে কোন সুন্দর নামেই তাকে ডাকা যায়। যেকোন সময়, এমনকি প্রার্থনাতেও।
প্রসঙ্গত, আল্লাহ নামটিও কোন স্বতন্ত্র নাম নয়। উপাস্যকে বোঝাতে আরবীতে (আল ইলাহ) আল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। নিউ টেস্টামেন্টে আমরা দেখি যীশু স্রষ্টাকে এলোই (আমার প্রভু) বলে সম্বোধন করছেন। (মার্ক: ১৫:৩৪) মুসা (সাঃ) এর কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন যিহোবা নামে আবার ইব্রাহিম (সাঃ) এর কাছে তার পরিচয় ছিল সর্বশক্তিমান ইশ্বর (হিব্রুতে এল শাদ্দাই)। (যাত্রাপুস্তক ৬:২-৩)। আরব খৃস্টানরাও তাদের উপাস্যকে বোঝাতে আল্লাহ শব্দটিই ব্যবহার করেন। বিভিন্ন জাতির কাছে সে জাতির ভাষাতেই পরমসত্তা নিজেকে প্রকাশ করেছেন।