জিহাদ মানে কি পবিত্র যুদ্ধ বা ধর্ম যুদ্ধ?

কোরআনের সবচেয়ে অপব্যবহূত শব্দগুলির মধ্যে অন্যতম জিহাদ। চরমপন্থী থেকে শুরু করে অনেকেই শব্দটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন। বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমেও এর যথেচছ ব্যবহার করে এর অর্থকে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। জিহাদ বলতে এখন তাই অনেকেই বোঝেন পবিত্র যুদ্ধ’ যা চাপিয়ে দেওয়া হয় অমুসলিমদের উপর। (যদিও সম্প্রতি Èজিহাদিদের’ হাতে অমুসলিম/মুসলিম সবাই নির্বিচারে মারা যাচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে মুসলিমদের সংখ্যাই বেশি) অথচ যে কোরআন এই শব্দটির উত্স, সেখানে শব্দটির অর্থ অনেক বিস্তুৃত। তবে এই অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে শুধু মুসলিমরা নন অমুসলিম পন্ডিতেরাও সোচ্চার একইভাবে।

কানাডার পন্ডিত লেখক ডক্টর টমাস আরভিং যিনি ১৯৫০ এর দশকে ইসলাম গ্রহণ করেন, ১৯৮৫ সালে কোরআন: দি ফার্স্ট আমেরিকান ট্রান্সলেশন প্রকাশ করেন, তঁার কোরআন অনুবাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে জিহাদ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন,

Í… যথাযথ অনুবাদে জিহাদ শব্দের অর্থ পবিত্র যুদ্ধ হতে পারে না, যদি না এর অর্থের সীমা বদলে নেওয়া হয়। সাংবাদিকরা এভাবে শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন যা এর অর্থের বিচু্যতি ঘটিয়েছে।” (আজিজ জেড ইসলাম, পিস অ্যান্ড টলারেন্স, টেন ভিউস অফ এমিনেন্ট স্কলারস, চ্যাপ্টার ১০.)

আরবী, ইসলামিক স্টাডিজের পন্ডিত ও ভাষাবিদ ডক্টর জি ডবি্লউ লিটনার বলেছেন,

… কেউ যখন বলে জিহাদ বলতে মোহাম্মদের অনুসারী কতর্ৃক অনৈসলামিক (নন-মোহামেডান) সরকার বা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে বোঝায় এবং একে তারা জিহাদ বলে (যদিও বিশেষ অবস্থায় এ অর্থেও শব্দটি ব্যবহূত হতে পারে), তাহলে বলতে হয়, তারা আবোলতাবোল বলছেন। তারা (জিহাদ শব্দ প্রসঙ্গে) অনুচিতভাবে বিদ্বেষপূর্ণ কুত্সা রটনা করছেন একটি ধর্মের বিরুদ্ধে যে ধারণার সঙ্গে তারা পরিচিত নয়।” (আজিজ জেড ইসলাম, পিস অ্যান্ড টলারেন্স, টেন ভিউস অফ এমিনেন্ট স্কলারস, চ্যাপ্টার ১০.)

ক্লাসিকাল অভিধানকাররা জিহাদের মূল অর্থ বলে উলে্লখ করেছেন – নিরন্তর সংগ্রাম, পরিশ্রম/প্রচষ্টো, কায়োমনোবাক্যে আপ্রাণ চষ্টো।

দেখুন ARABIC-ENGLISH DICTIONARY OF QUR’ANIC USAGE BY ELSAID M. BADAWI and MUHAMMAD ABDEL HALEEM (পৃষ্ঠা ১৭৭-১৭৮) কিংবা

Edward Lanes Lexicon, Williams and Norgate 1863; Librairie du Liban Beirut-Lebanon 1968 (ভলিউম ২, পৃষ্ঠা ৪৭৩)

এই প্রাথমিক অর্থটির সমর্থন মেলে কোরআনে। একটি আয়াতে একইসঙ্গে শব্দটির বীপরিত শব্দের ব্যবহার দিয়েও এর অর্থকে আরো পরিস্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

৪:৯৫

মুমিনদের মধ্যে যাহারা অক্ষম (আরবী দারারি) নয় অথচ ঘরে বসিয়া থাকে (আরবী কায়িদুনা) ও যাহারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন (আরবী আমওয়ালিহিম) প্রাণ (আরবী আনফুসিহিম) দ্বারা জিহাদ করে (আরবী মুজাহিদুনা) তাহারা সমান নয়। যাহারা স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ তাহাদেরকে এবং যাহারা ঘরে বসিয়া থাকে তাহাদের উপর মর্যাদা দিয়াছেন; আল্লাহ সকলকেই কল্যানের প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। যাহারা ঘরে বসিয়া থাকে (আরবী কায়িদিনা) তাহাদের উপর যাহারা জিহাদ করে তাহাদেরকে আল্লাহ মহাপুরস্কারের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াছেন।

আরবী শব্দ কাআদা মানে অপেক্ষা করা, শুয়ে অপেক্ষা করা, স্থির হয়ে থাকা, বিরত থাকা, যে বাসায় বসে থাকে, পিছনে থাকে, অবেহলা করে, বিরত থাকে। এর বিপরীতে জিহাদ শব্দটির অর্থ কী হবে তা সহজেই বোধগম্য। (আর আনফুসিহিম শব্দটি এসেছে নফস থেকে। এর মূল অর্থ আত্মা, ব্যক্তি, অসি্তত্ব, অহং ইত্যাদি। প্রাণ বা জীবনও হতে পারে, তবে সেটাই এর একমাত্র অর্থ নয়। কেউ তার নফসের সঙ্গে লড়াই করছে বললে আমরা মানসিক লড়াইয়ের কথাই বুঝি। তাছাড়া জীবন বা লাইফ আরবী হাইয়া/হায়াত্ শব্দটির বেশী নিকটতর বলে মনে হয়। )

যুদ্ধের মাধ্যমেও সংগ্রাম করা যায় না তা নয়। কিন্তু কোরআনের শর্ত হলো, নিদ্দষ্টি প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট নিপীড়নের বিরুদ্ধেই কেবলমাত্র এরকম সংগ্রাম (যুদ্ধ) করা যাবে।

২২:৩৯-৪০

যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হইল তাহাদেরকে যাহারা আক্রান্ত হইয়াছে। কারণ তাহাদের প্রতি অত্যাচার হইয়াছে। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাহাদেরকে সাহায্য করিতে সম্যক সক্ষম। তাহাদেরকে তাহাদের ঘর-বাড়ি হইতে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হইয়াছে শুধু এই কারণে যে, তাহারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করিতেন তাহা হইলে বিধ্বস্ত হইয়া যাইত খ্রিস্টান সংসারবিবাগীদের উপাসনাস্থান, গীর্জা, ইয়াহুদিদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমুহ যেখানে অধিক স্মরণ হয় আল্লাহর নাম। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাহাকে সাহায্য করেন যে তাহাকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।

(এই আয়াতে মঠ, গীর্জা ও মসজিদকে একইসঙ্গে উলে্লখ করা হয়েছে। এর সবগুলিকেই উপাসনার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আর আয়াতে অত্যাচারের প্রতিবিধানকল্পেই যুদ্ধের বিষয়টি পরিস্কারভাবেই উলে্লখ করা হয়েছে।)

৬০:৮

দীনের ব্যাপারে যাহারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নাই এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হইতে বহিষ্কার করে নাই তাহাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করিতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়নদেরকে ভালবাসেন।

(এই আয়াতেও পরিস্কার, যারা আক্রমণ করেনি তাদের বিরুদ্ধে কোনরকম অত্যাচার করা যাবে না। ধর্ম-সংস্কৃতির উর্ধে সব মানুষকেই মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, তার সঙ্গে মানবিক/ন্যায়সম্মত আচরণ করতে হবে।)

মোটকথা, কোরআনের আলোকে অমুসলিম/মুসলিম কারো উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে তাকে জিহাদ বলার কোন সুযোগ নাই। কোরআনে জিহাদ শব্দের প্রাথমিক অর্থ কঠোর চষ্টো/সংগ্রাম কিংবা আল্লাহর পথে নিরন্তর সংগ্রাম ও পরিশ্রম।

৪৭:৩১

আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করিব, যতক্ষন না আমি জানিয়া লই তোমাদের মধ্যে জিহাদকারী ও ধৈর্যশীলদেরকে এবং আমি তোমাদের ব্যাপারে পরীক্ষা করি।

অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদের যে আহ্বান দেওয়া হচ্ছে আজকাল যুদ্ধবাজ মুসলিম নেতাদের তরফে তাদের মূল হাতিয়ার ইসলামের বিভিন্ন সেকেন্ডারি সোর্স। সেখান থেকে নানান বক্তব্য ব্যাবহার করে তারা তরুন সম্প্রদায়কে বোঝানোর চষ্টো করে যে, দেখো কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরজ। কনটেক্সের বাইরে গিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কোরআনের আয়াতের সঙ্গে ওইসব বয়ান মিলিয়ে তাদের বক্তব্যকে বৈধতা দেওয়ার চষ্টো করে তারা।

অথচ কোরআনে যুদ্ধের বিধান দেওয়া হয়েছে কেবল এবং কেবলমাত্র যদি কেউ আক্রান্ত হয়, আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ করতে পারবে, তবে সীমা লংঘন করা যাবে না। আর যদি আক্রমণকারী থেমে যায় তবে প্রতিআক্রমণকারীকেও থেমে যেতে হবে। শানি্তর পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্যও জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

২:১৯০-৯৪

যাহারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহর পথে তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; কিন্তু সীমালংঘন করিও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না। যেখানে তাহাদেরকে পাইবে হত্যা করিবে এবং যে স্থান হইতে তাহারা তোমাদের বহিষ্কার করিয়াছে তোমরাও সেই স্থান হইতে তাহাদের বহিষ্কার করিবে। ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর। মসজিদুল হারামের নিকট তোমরা তাহাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিবে না, যে পর্যন্ত তাহারা সেখানে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে। যদি তাহারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তবে তোমরা তাহাদেরকে হত্যা করিবে, ইহাই কাফিরদের পরিণাম। যদি তাহারা বিরত হয় তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আর তোমরা তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে থাকিবে যাবত্ ফিতনা দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত না হয়। যদি তাহারা বিরত হয় তবে জালিমদেরকে ব্যতীত কাহাকেও আক্রমণ করা চলিবে না।

লক্ষণীয় এখানে যুদ্ধের যে বিধান দেওয়া হয়েছে সেটা মসজিদুল হারামকে ঘিরে, তত্কালীন মুমিনদের লক্ষ্য করে। তবে আত্মরক্ষার শাশ্বত বিধানটি এখানে স্বতঃপ্রমাণিত।

শানি্তর ব্যাপারেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যথোচিত।

৮:৬১

তাহারা যদি সন্ধির দিকে ঝঁুকিয়া পড়ে তবে তুমিও সন্ধির দিকে ঝঁুকিবে এবং আল্লাহর উপর নির্ভর করিবে। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

কোন ধর্মীয় বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনের চেয়েও একটি শানি্ত চুক্তি যে গুরুত্বপূর্ণ সেটি নিচের আয়াতে পরিস্কার।

৮:৭২

যাহারা ঈমান আনিয়াছে, হিজরত করিয়াছে, নিজেদের জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করিয়াছে; আর যাহারা আশ্রয় দান করিয়াছে ও সাহায্য করিয়াছে তাহারা পরষ্পরের বন্ধু। আর যাহারা ঈমান আনিয়াছে কিন্তু হিজরত করে নাই, হিজরত না করা পর্যন্ত তাহাদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব তোমাদের নাই; আর দীন সম্বন্ধে যদি তাহারা তোমাদের সাহায্য প্রার্থনা করে তবে তাহাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। কিন্তু যে সম্প্রদায় ও তোমাদের মধ্যে চুক্তি রহিয়াছে তাহাদের বিরুদ্ধে নহে। তোমরা যাহা কর আল্লাহ উহার সম্যক দ্রষ্টা।

ধর্মকে ব্যবহার করে, ধর্মের নামে গণহত্যা, ফেত্না ফ্যাসাদ পৃথিবীতে নতুন কিছু নয়। হয়েছে, হচ্ছে। এমনকি পাকিস্তানি মুসলিমরাও বাংলাদেশের মুসলিমদের উপর যে গণহত্যা চালিয়েছে সেটাও ধর্মের নাম করে। এখনো এদেশের অনেক সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতন হয় ধর্মের নাম করে। ক্রুসেড, স্প্যানিশ ইনকুইজিশন, বসনিয়ার গণহত্যা, গুজরাটের গণহত্যা সবই তো কোন না কোনভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে। অতীতে বেৌদ্ধদের হাতে হিন্দু নিধন এবং হিন্দুদের হাতে বেৌদ্ধ নিধনও ধর্মের ধ্বজ্জা ব্যবহার করেই। অথচ কোন ধর্মই কিন্তু নির্বিচার হত্যাকে সমর্থন করে না। এখনও ইসলামের নামে বিশ্বব্যাপী যা হচ্ছে তার সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই।

জিহাদের নামে যে যাই করুক, দিন শেষে যার যার কর্মের দায় তাকেই বহন করতে হবে।

Scroll to Top