জমজমের পানি

বর্তমানে মুসলিম সমাজের অনেকেই জমজমের পানিকে পবিত্র এবং রোগউপশমকারী বিশেষ গুণসম্পন্ন মনে করেন। ইব্রাহিম (সাঃ) এর স্ত্রী হাজেরা এবং তার পুত্র ইসমাইল (সাঃ), সাফা ও মারওয়া ইত্যাদি কাহিনীর সঙ্গে এই পানির উত্স তৈরির কাহিনীও জড়িয়ে আছে চমকপ্রদভাবে।

উল্লেখ্য কোরআনে জমজমের পানি বা সংশ্লিষ্ট কাহিনীর লেশমাত্র নেই।

কোরআনে অনেক অনুপ্রেরণামূলক ও ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা আছে যা মানবজাতিকে বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়।

১২:১১১ উহাদের বৃত্তান্তে বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য আছে শিক্ষা। ইহা এমন বাণী (আরবী হাদিছান) যাহা মিথ্যা রচনা নহে। কিন্তু মুমিনদের জন্য ইহা পূর্বগ্রন্থে (আরবী বায়না ইয়াদায়হি) যাহা আছে তাহার সমর্থন এবং সমস্ত কিছুর বিশদ বিবরণ, হিদায়াত ও রহমত।

কিন্তু কোরআনের কোথাও হাজেরা বা হাজেরা-ইসমাইল কাহিনীর বা জমজম কূপের কোন বর্ণনা নেই। এ সম্পর্কে কোন আভাস-ইঙ্গিতও নেই। সাফা-মারওয়ার উল্লেখ কোরআনে আছে স্রেফ দুটি নিদর্শন হিসেবে। একে পাহাড় হিসেবেও বর্ণনা করা হয়নি। কোরআনে শুধু বলা হয়েছে অতীতের আরবরা সাফা ও মারওয়া তাওয়াফ করতো হজের সময় চাইলে তারা সেটা চালু রাখতে পারে। বিষয়টাকে ঐচ্ছিক করা হয়েছে, বাধ্যতামূলক নয়। সাফা-মারওয়ার সাথে হাজেরা-ইসমাইলের যে কাহিনীর বর্ণনা আমরা পাই তার সঙ্গে কোরআনের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, এর উত্স ইসলামের সেকেন্ডারি সোর্স হাদিস।

২:১৫৮ নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের (আরবী শা’আয়িরি) অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং যে কেহ কাবা গৃহের হজ্জ কিংবা উমরা সম্পন্ন করে এই দুইটির মধ্যে সাঈ (আরবী ইয়াত্তাওয়্যাফা) করিলে তাহার কোন পাপ নাই আর কেহ স্বতঃস্ফুর্তভাবে সত্কার্য করিলে আল্লাহ তো পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ।

উপরের আয়াতটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে নব্য মুসলিমদের (আগে যারা মুশরিক ছিলেন) মনে এ প্রশ্ন নিশ্চিত জেগেছিল যে, হজ তো আগেও ছিল, এখন ইসলামের বিধানে ওই দুটি নিদর্শন তাওয়াফ করা কি সঙ্গত কি না? এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এই দুইটির মধ্যে সাঈ (আরবী ইয়াত্তাওয়্যাফা) করিলে তাহার কোন পাপ নাই’।

এখানে লক্ষনীয়, কোরআন কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে বিধানটি দিচ্ছে না বা চাপিয়ে দিচ্ছে না। বরং পৌত্তলিক আরবদের একটি চর্চাকে নব্য মুসলিমরা চাইলে অব্যাহত রাখতে পারে।

মুসলিমদের জন্য কী প্রয়োজন বা উপকারী, কী ভাল কী মন্দ সে সম্পর্কে বিস্তর উদাহরণ কোরআনে দেওয়া হয়েছে। দুধ, মধুসহ বিভিন্ন পানীয়ের কথা বলা যায়। কিন্তু কোরআনের কোথাও জমজমের পানির উপকারী বৈশিষ্ট্য বিশেষ করে তার রোগনিবারক গুন সম্পর্কে কোন কথাই নেই।

১৬:৬৮-৬৯ তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে উহার অন্তরে ইংগিত দ্বারা নির্দেশ দিয়াছেন, গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে গৃহ নির্মান করে তাহাতে, ইহার পর প্রত্যেক ফল হইতে কিছু কিছু আহার কর, অতঃপর তোমার প্রতিপালকের সহজ পথ অনুসরণ কর। উহার উদর হইতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়; যাহাতে মানুষের জন্য রহিয়াছে আরোগ্য (শিফাও-লিলনাসি)। অবশ্যই ইহাতে রহিয়াছে নিদর্শন চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।

দুধের উপকারিতার ইঙ্গিতও রয়েছে কোরআনে। (১৬:৬৬)
৪৭:১৫ আয়াতে জান্নাতের নহর প্রসঙ্গে পানি, মধু ও সুরার নহরের পাশাপাশি দুধের নহরের উল্লেখও আছে।

বৃষ্টির পানির পুনরুজ্জীবিত করার বৈশিষ্ট্যও বর্ণনা করা হয়েছে কোরআনে।

৫০:৯ আকাশ হইতে আমি বর্ষণ করি কল্যানকর (আরবী মুবারাকান) বৃষ্টি ও তদ্দ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান ও পরিপক্ক শস্যরাজি।

নিচের আয়াতে তীর্থযাত্রীদের জন্য পানি সরবরাহের উদ্যোগটি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এবং লক্ষণীয় বক্তব্যটি তিরস্কারমূলক। এবং এখানে জমজমের পানি বা এর নিরাময় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোনও উল্লেখ নেই।

৯:১৯ হাজীদের জন্য পানি সরবরাহ এবং মসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে কি তোমরা তাহাদের পুণ্যের সমজ্ঞান কর, যাহারা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান আনে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করে? আল্লাহর নিকট উহারা সমতুল্য নহে। আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সত্পথ প্রদর্শন করেন না।

মোদ্দাকথা, কোরআনে বিভিন্ন রকম পানীয়র গুণগান বর্ণনা করা হলেও কোথাও জমজমের পানির উল্লেখমাত্র নেই। জমজমের পানিতে ওষধি গুণ আরোপ করা হয়েছে হাদিস তথা সেকেন্ডারি সোর্সগুলোতে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top