মুসলিমদের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে হাদিস ছাড়া কোরআন বোঝা বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। প্রশ্নটা হলো, হাদিসের বইগুলোতে নবীর (সাঃ) নামে যে ব্যাখ্যা আমরা পাই সেটা নবীজীরই কি না তার গ্যারান্টি কী? আজকে আমাদের কাছে হাদিসের যে বিপুল সংগ্রহ আছে তা দিয়ে কোরআনের কতটুকু ব্যাখ্যা করা যায়, সেটাও একটা প্রশ্ন।
প্রকৃতপক্ষে হাদিসের যেসব বই আমরা পেয়েছি সেগুলি সম্পূর্ণ কোরআনকে ব্যাখ্যা তো করেই না। যে গুটিকয়েক আয়াতের ব্যাখ্যা মেলে সেসবও নির্বিকারে মেনে নেওয়া দুরুহ। দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
উদাহরণ : এক
১১:১১৪ : তুমি সালাত কায়েম কর দিবসের দুই প্রান্তভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে। সত্কর্ম অবশ্যই মিটাইয়া দেয় অসত্কর্ম। যাহারা উপদেশ গ্রহণ করে, ইহা তাহাদের জন্য এক উপদেশ।
বুখারির হাদিসে এই আয়াতের ব্যাখ্যা :
এক লোক এক নারীকে চুম্বন করে তারপর আল্লাহর নবীর কাছে এসে তার অপকর্মের কথা স্বীকার করে। তখন আয়াত নাজিল হয়। (১১:১১৪) ‘তুমি সালাত কায়েম কর দিবসের দুই প্রান্তভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে। সত্কর্ম অবশ্যই মিটাইয়া দেয় অসত্কর্ম। যাহারা উপদেশ গ্রহণ করে, ইহা তাহাদের জন্য এক উপদেশ।’ একথা শোনার পর লোকটি বলে, এটা কি শুধু আমার জন্য? নবী (সাঃ) বলেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে যারাই এরকম পরিস্থিতিতে পরবে তাদের সবার জন্যই এই আয়াত প্রযোজ্য।’ (ভলিউম ৬ বুক ৬০ হাদিস নং ২০৯)
ওই রমণীটি লোকটির স্ত্রী নয়, নিশ্চিত। হলে অপরাধ স্বীকার করার কোন কথা উঠতো না। তাহলে বিষয়টা দাড়াচ্ছে এরকম, যে কেউ বিবাহ বহির্ভূত অনাচার করে এসে সালাত আদায় করে নিলেই হবে। তাই কি?
উদাহারণ : দুই
৩৩:৬৯ – হে মুমিনগণ! মুসাকে যাহারা ক্লেশ দিয়াছে/বিব্রত করিয়াছে তোমরা উহাদের ন্যায় হইও না। উহারা যাহা বলিয়াছিল আল্লাহ উহা হইতে তাহাকে নির্দোষ প্রমাণ করেন এবং আল্লাহর নিকট সে মর্যাদাবান।
বনী ইসরায়েল কিভাবে মুসা (সাঃ) বিব্রত করেছিল বা কষ্ট দিয়েছিল? কোরআনেই তার উত্তর রয়েছে বিস্তারিতভাবে।
ফিরাউনের হাত থেকে বনী ইসরাইলকে উদ্ধারের পর তারা বলেছিল-
৭:১২৯ তাহারা বলিল, ‘আমাদের নিকট তোমার আসিবার পূর্বে আমরা নির্যাতিত হইয়াছি এবং তোমার আসিবার পরেও।’
আল্লাহ যখন তাদের খাবারের ব্যবস্থা করলেন তখন তারা বলেছিল-
২:৬১ যখন তোমরা বলিয়াছিলে, হে মুসা আমরা একইরকম খাদ্যে কখনও ধৈর্য ধারন করিব না। তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে আমাদের জন্য প্রার্থনা কর- তিনি যেন ভূমিজাত দ্রব্য শাক-সব্জি, কাঁকুড়, গম, মসুর ও পেঁয়াজ আমাদের জন্য উত্পাদন করেন।.. .. ..’
যখন তারা একটি উপত্যকা দিয়ে যাচ্ছিল কিছু লোককে মূর্তি পূজা করতে দেখে তারা আবদার ধরল-
৭:১৩৮ আর আমি বনী ইসরাইলকে সমুদ্র পার করাইয়া দেই; অতঃপর তাহারা প্রতিমা পূজায় রত এক জাতির নিকট উপস্থিত হয়। তাহারা বলিল, ‘মুসা! তাহাদের দেবতার ন্যায় আমাদের জন্যও এক দেবতা গড়িয়া দাও।’.. ..
তাদেরকে বিস্তর নিদর্শন দেখানোর পরও তারা বলেছিল-
২:৫৫ যখন তোমরা বলিয়াছিলে, হে মুসা! আমরা আল্লাহকে প্রত্যক্ষভাবে না দেখা পর্যন্ত তোমাকে কখনো বিশ্বাস করিব না।.. ..
যখন যুদ্ধের জন্য মুসা (সাঃ) তাদের আহ্বান করলেন তখন তারা বলল-
৫:২৪ তাহারা বলিল, হে মুসা! তাহারা যত দিন সেখানে থাকিবে তত দিন আমরা প্রবেশ করিবই না। সুতরাং তুমি আর তোমার প্রতিপালক যাও এবং যুদ্ধ কর, আমরা এখানেই বসিয়া থাকিব।
তাদের এইসব আচরণের জন্য মুসা (সাঃ) বিরক্ত ছিলেন, বিব্রত ছিলেন। নিচের আয়াতটি দেখুন :
৬১:৫ স্মরণ কর, মুসা তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আমাকে কেন কষ্ট দিতেছ যখন তোমরা জান যে, আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসুল।.. ..
উপরের আয়াতগুলো থেকে পরিস্কার মন ও স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়েই যে কেউ বুঝতে পারবেন মুসা নবীকে বিব্রত করার ব্যাপারে কোরআনের ব্যাখ্যা কি?
এখন এ প্রসঙ্গে বুখারির ব্যাখ্যা কি দেখা যাক। ৩৩:৬৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় বুখারির বর্ণনা :
আল্লাহর নবী বলেন, ‘(নবী) মুসা ছিলেন খুবই লাজুক প্রকৃতির। অতিরিক্ত লাজুকতার জন্য তিনি সর্বদা পুরো শরীর আবৃত করে রাখতেন। একদিন বনী ইসরাইলের একজন তাকে আক্রমণ করে বললেন, তিনি তো এভাবে তার শরীর ঢেকে রাখেন কারণ তার চামড়ায় কিছু খুত আছে, হয় কুষ্ঠ বা হার্নিয়া কিংবা অন্য কোন সমস্যা আছে। তার সম্পর্কে এহেন অভিযোগের উত্তর দিতে চাইলেন আল্লাহ। সুতরাং একদিন মুসা (সাঃ) যখন নির্জনে ছিলেন তিনি তার কাপড় খুলে একটি পাথরের উপরে রেখে গোসল করতে লাগলেন। গোসল শেষ হলে তিনি যখন কাপড়ের দিকে গেলেন তখন পাথরটি কাপড় নিয়ে উড়ে যেতে লাগল। মুসা(সাঃ) তার লাঠি নিলেন এবং পাথরের দিকে দৌড়াতে লাগলেন একথা বলে যে, হে পাথর! আমার পোশাক দাও। বনী ইসলাইলের একদল লোকের সামনে আসা পর্যন্ত এভাবে পাথরটি উড়ে গেল। ওই লোকেরা নগ্ন অবস্থায় মুসা নবীকে দেখল এবং তার বুঝতে পারল আল্লাহ কত নিখুতভাবে তাকে তৈরি করেছেন। এভাবে তার সম্পর্কে যে অভিযোগ তারা করছিল তার নিরসন হলো। ওইখানে পাথরটি থামল, মুসা (সাঃ) গিয়ে তার পোশাক পরিধান করলেন এবং তারপর লাঠি দিয়ে পাথরটাকে আঘাত করতে লাগলেন। আল্লাহর শপথ, ওই পাথরটির শরীরের সেই আঘাতের চিহ্ন এখনো আছে- তিনটি, চারটি বা পাঁচটি। এই ঘটনার কথাই আল্লাহ বলেছেন এই আয়াতে: হে মুমিনগণ! মুসাকে যাহারা ক্লেশ দিয়াছে/বিব্রত করিয়াছে তোমরা উহাদের ন্যায় হইও না। উহারা যাহা বলিয়াছিল আল্লাহ উহা হইতে তাহাকে নির্দোষ প্রমাণ করেন এবং আল্লাহর নিকট সে মর্যাদাবান। (৩৩:৬৯)
(বুখারি ভলিউম ৪ বুক নম্বর ৫৫ হাদিস নম্বর ৬১৬)
এই হাদিসের ব্যাপারে কোন মন্তব্য দরকার আছে বলে মনে হয় না। উল্লেখ্য, এরকম অনেক হাদিসের সূত্র ধরে এখনো মুতা বিবাহ, ব্যভিচারের জন্য পাথর ছুড়ে হত্যার বিধান চালু রয়েছে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে।
অথচ, কোরআনে কিন্তু বহুবার এই কিতাবকে ‘বিস্তারিত ও সবকিছুর পরিস্কার ব্যাখ্যা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
১৭:৮৯ আর অবশ্যই আমি মানুষের জন্য এই কুরআনে বিভিন্ন উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করিয়াছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কুফরি করা ব্যতীত ক্ষান্ত হইল না।
১৮:৫৪ আমি মানুষের জন্য এই কুরআনে বিভিন্ন উপমা দ্বারা আমার বাণী বিশদভাবে বর্ণনা করিয়াছি। মানুষ অধিকাংশ ব্যাপারেই বিতর্কপ্রিয়।
১৬:৮৯ ..আমি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ের (লিকুল্লি শায়্যি) স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরুপ, পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরুপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করিলাম।’
৪১:৩ এক কিতাব, বিশদভাবে বিবৃত হইয়াছে ইহার আয়াতসমুহ, আরবী ভাষায় কুরআন, জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য।
৬:১২৬ ইহাই তোমার প্রতিপালক নির্দেশিত সরল পথ। যাহারা উপদেশ গ্রহণ করে আমি তাহাদের জন্য নিদর্শনসমুহ বিশদভাবে বিবৃত করিয়াছি।
২:১৫৯ নিশ্চয়ই আমি যেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও হিদায়াত অবতীর্ণ করিয়াছি মানুষের জন্য কিতাবে উহা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পরও যাহারা উহা গোপন রাখে আল্লাহ তাহাদের লানত দেন এব অভিশাপকারীরাও তাদের অভিশাপ দেয়।
যখন কেউ বলেন, ‘কোরআনে সবকিছু বলা নেই, বিস্তারিতভাবে বুঝতে হলে আমাদের হাদিসের কাছে যেতে হবে’, তখন তিনি আল্লাহর এসব উক্তির (বিশদভাবে বিবৃত হইয়াছে) বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যান নিজের অজান্তেই।
প্রসঙ্গত কোরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করা যায়।
৩১:৬ মানুষের মধ্যে কেহ কেহ অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ হইতে বিচ্যুত করিবার জন্য অসার বাক্য (আরবী লাহওয়াল হাদিসি) ক্রয় করিয়া নেয় এবং আল্লাহ প্রদর্শিত পথ লইয়া ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। উহাদের জন্য রহিয়াছে অবমাননাকর শাস্তি।
হাদিসের জন্য : http://www.sahih-bukhari.com/Pages/Bukhari_1_04.php
ঋণস্বীকার : http://www.quransmessage.com