সিয়াম পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত

২:১৮৭ … আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাত্রির কৃষ্ণরেখা হইতে উষার শুভ্র রেখা স্পষ্টরুপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়। অতঃপর রাত (আরবী লাইল) পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর।…

কোরআনের সুরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে বেশ পরিস্কার করেই বলা আছে – অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর।’ তবু অন্ধের মতো ভিত্তিহীন হাদিস, পূর্বপুরুষদের রেওয়াজ, সিংহভাগ মানুষের অনুসরণ করতে গিয়ে সন্ধ্যাতেই ইফতার করেন অধিকাংশ মুসলিম।

রাতের আরবী লাইল। যেমন লাইলাতুল কদর বলতে বুঝি কদরের রাত। কোরআন মজিদের সব জায়গাতেই লাইল মানে রাত, কোথাও সূর্যাস্ত লেখা নেই।

নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:

৬:৭৬ অতঃপর রাত্রির (আরবী লাইল) অন্ধকার যখন তাহাকে আচ্ছন্ন করিল তখন সে নড়্গত্র দেখিয়া বলিল, ইহাই আমার প্রতিপালক।…

১০:৬৭ তিনিই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন রাত্রি (আরবী লাইল), যেন উহাতে তোমরা বিশ্রাম করিতে পার এবং দিবস দেখিবার জন্য। যে সম্প্রদায় কথা শোনে নিশ্চয়ই তাহাদের জন্য ইহাতে আছে নিদর্শন।

১১:৮১ … সুতরাং রাত্রির (আরবী লাইল) কোন সময়ে তোমার পরিবারবর্গসহ বাহির হইয়া পড়।…

১২:১৬ উহারা রাত্রির (আরবী লাইল) প্রথম প্রহরে কাঁদিতে কাঁদিতে উহাদের পিতার নিকট আসিল।

২৫:৪৭ এবং তিনিই তোমাদের জন্য রাত্রিকে (আরবী লাইল) করিয়াছেন আবরণস্বরম্নপ, বিশ্রামের জন্য তোমাদের জন্য দিয়াছেন নিদ্রা এবং সমুত্থানের জন্য দিয়াছেনর দিবস।

৩১:২৯ তুমি কি দেখ না আলস্নাহ রাত্রিকে (আরবী লাইল) দিবসে এবং দিবসকে রাত্রিকে পরিণত করেন?

৭৩:২০ তোমার প্রতিপালক তো জানেন যে, তুমি জাগরণ কর কখনো রাত্রির (আরবী লাইল) প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ

৭৯:২৯ আর রাত্রিকে (আরবী লাইল) করিয়াছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং প্রকাশ করিয়াছেন ইহার সূর্যালোক;

৯১:১-৪ শপথ সূর্যের এবং উহার কিরণের, শপথ চন্দ্রের যখন উহা সূর্যের পর আবির্ভূত হয়, শপথ দিবসের, যখন সে উহাকে প্রকাশ করে , শপথ রজনীর (আরবী লাইল), যখন সে উহাকে আচ্ছাদিত করে।

রাতের আরো অনেক উলেস্নখ কোরআনে আছে (১৬২টি আয়াতে)। সর্বত্রই রাত বোঝাতে লাইল শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

কোরানে সন্ধ্যা বা সূর্যাস্তের বর্ণনাও আছে। কিন্তু কোথাও সূর্যাস্ত বা সূর্যাস্তকালীন সময়কে বোঝাতে লাইল শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। সেজন্য ব্যবহার করা হয়েছে আলাদা শব্দ -আসিলান, গুরুব, কিংবা শাফাক্ব ইত্যাদি

২৫:৫ উহারা বলে, এইগুলি তো সে কালের উপকথা যাহা সে লিখাইয়া লইয়াছে; এইগুলি সকাল সন্ধ্যায় (আরবী আসিলান) তাহার নিকট পাঠ করা হয়।

৪৮:৯ ৯. যাহাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁহার রাসুলের প্রতি ঈমান আন এবং রাসুলকে শক্তি যোগাও ও তাহাকে সম্মান কর; সকাল-সন্ধ্যায় (আরবী আসিলান) আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।

২৭:২০৫ ২০৫. তোমার প্রতিপালককে মনে মনে সবিনয় ও সশংকচিত্তে অনুচ্চস্বরে প্রত্যূষে ও সন্ধ্যায় (আরবী আসালি) স্মরণ করিবে এবং তুমি উদাসীন হইবে না।

১৮:৮৬ চলিতে চলিতে সে যখন সূর্যের অস্তগমন স্থানে পৌছিল। (আরবী : মাগরিবাশ শামস)

২০:১৩০…সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের (আরবী গুরুবিহা) আগে তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো।

৫০:৩৯ …তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর সকাল ও সন্ধ্যায়। স–র্যোদয়ের প–র্বে ও স–র্যাসেত্মর প–র্বে।

কোরানে গুরুব ব্যবহারের আরো উদাহরণ আছে। শব্দটা যেহেতু বহুল ব্যবহৃত, সিয়াম শেষের সময় হিসেবে সূর্যাস্ত বোঝাতে চাইলে ওই শব্দটিই আল্লাহ ব্যবহার করতেন কোন রকম অস্পষ্টতা না রেখে। কিন্তু সেটা করা হয়নি। পরিস্কারভাবে লাইল শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সিয়াম শেষের সময়কে বোঝাতে।

শাফাক্কের ক্ষেত্রেও একই কথা। আরবী অভিধানে শাফাক্ব বলতে দিগন্তের লালিমা বা দি রেডনেস ইন দি হরাইজন উল্লেখ করা হয়েছে। (লেনের লেক্সিকন, ভলিউম ৪ পৃষ্ঠা ১৫৭৩)

সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে রক্তিম আভার সৃষ্টি হয় এবং এটি গড়ে ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় থাকে। এই সময়টুকুকে সুরা ইনশিক্বাকের ১৬ নম্বর আয়াতে শাফাক্ব শব্দে বর্ণনা করা হয়েছে। আর শাফাক্বের পূর্ণ সমাপ্তির পরই যে লাইল বা রাতের শুরু হয় তাও সুরাটির ১৭ নম্বর আয়াত দ্বারা প্রমাণিত।

৮৪:১৬-১৭ আমি শপথ করি অস্তরাগের (শাফাক্ব) এবং রাত্রির (লাইল) আর উহা যাহা কিছুর সমাবেশ ঘটায় তাহার।

এখানে শাফাক্ব এবং লাইলকে আলাদা এবং শাফাক্বের পরে লাইল আসার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

সুতরাং অনেকেই যে বলেন, সন্ধ্যা তো রাতের অংশ; গুরুব, শাফাক এগুলো রাতেরই পর্যায়, তা ঠিক নয়। এগুলো মনগড়া কথা। কারণ কোরআন শরিফে রাত ও দিনের পরিচয় খুব পরিস্কার করেই আল্লাহ ব্যাখ্যা করেছেন। রাত ও দিনের নির্ধারণ তো আল্লাহই ভালো করতে পারবেন। (৭৮:১১)

আরবী অভিধানেও এর পরিস্কার ব্যাখ্যা আছে।

আরবীতে দিন বলতে নাহারকে বোঝানো হয়। নাহার এর অর্থ প্রসঙ্গে এডোয়ার্ড লেনের ডিকশনারিতে বলা হয়েছে- ডে, অর ডে-টাইম। (ভলিউম ৮, পৃষ্ঠা ২৮৫৮)। আবদুল মান্নান ওমর ডিকশনারিতে নাহার এর অর্থ লেখা হয়েছে- এ ডে ফ্রম ডন টু ডাস্ক অ্যাজ অপোজড টু লাইল। (ডিকশনারি অফ দি হোলি কোরআন, পৃষ্ঠা ৫৮০)। এ জে পেনরাইস, হ্যান্স ওয়েরসহ অন্য অনেক অভিধানে ও নির্ঘন্টে দিনের সংজ্ঞা এভাবেই দেওয়া হয়েছে।

তবে এহ বাহ্য। কোরআন শরিফেই দিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ খুব পরিস্কার করেই বলেছেন –

১০:৬৭ তিনিই সৃষ্টি করিয়াছেন তোমাদের জন্য রাত্রি (আরবী লাইল) যেন উহাতে তোমরা বিশ্রাম করিতে পার এবং দিবস দেখিবার জন্য (আরবী মুবশিরান)।

১৭:১২ আমি রাত্রি ও দিবসে করিয়াছি দুইটি নিদর্শন, রাত্রির নিদর্শনকে অপসারিত করিয়াছি এবং দিবসের নিদর্শনকে দৃষ্টিগোচার/দর্শনসাধ্য (আরবী মুবশিরাতান) করিয়াছি যাহাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করিতে পার এবং যাহাতে তোমরা বর্ষসংখ্যা ও হিসাব জানিতে পার; এবং আমি সব কিছু বিশদভাবে বর্ণনা করিয়াছি।

২৭:৮৬ উহারা কি অনুধাবন করে না যে, আমি রাত্রি সৃষ্টি করিয়াছি উহাদের বিশ্রামের জন্য এবং দিবসকে করিয়াছি দেখার জন্য (আরবী মুবশিরান) ইহাতে মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রহিয়াছে।

এখানে খুব পরিস্কার করেই বলা হয়েছে যে দিবসের বৈশিষ্ট্য হলো এ সময়ে দেখা যাবে। আরবীতে বাশার মানে দৃষ্টি, দেখার অনুভূতি, চক্ষু, চোখ। (১৬:৭৮ ইত্যাদি) । যে দেখতে পায় তাকে বলা হয় বাশির। আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম সর্বদ্রষ্টা বা আল বাশির (৩১:২৮ ইত্যাদি)। সন্ধ্যায় মাগরেবের আযানের সময় খুব পরিস্কারভাবেই আমরা চারদিকের সব কিছু দেখতে পাই। কাজে কাজেই, সন্ধ্যা দিনের অংশ, রাতের নয়।

নিচের আয়াতগুলিতেও দিন ও রাতের পার্থক্য স্পষ্ট হয়।

৯১:৩-৪ শপথ দিবসের, যখন সে উহাকে প্রকাশ করে। শপথ রজনীর, যখন সে উহাকে আচ্ছাদিত করে।

৯২:১-২ শপথ রজনীর, যখন সে আচ্ছন্ন করে, শপথ দিবসের, যখন উহা উদ্ভাসিত হয়।

৩৬:৩৭ উহাদের জন্য এক নিদর্শন রাত্রি, উহা হইতে আমি দিবালোক অপসারিত করি, তখন উহারা অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া পড়ে।

সালাত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন-

১১:১১৪ তুমি নামাজ কায়েম কর দিনের (আরবী নাহার) দুই প্রান্তভাগে এবং রাতের প্রথম অংশে।

সুষ্পষ্টভাবেই এখানে দিনের দুই প্রান্তভাগের নামাজ বলতে ফজর ও মাগরিবের কথা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মাগরিবের সময়টা দিনের ভিতরেই পড়ে, রাতের ভিতরে নয়।

১৩:১০ তোমাদের মধ্যে যে কথা গোপন রাখে অথবা উহা প্রকাশ করে, রাত্রিতে যে লুকিয়ে থাকে বা আত্মগোপন করে এবং দিবসে যে প্রকাশ্যে বিচরণ করে, তাহারা সমভাবে আল্লাহর জ্ঞানগোচর।

সন্ধ্যার যে আলোছায়া সেটা আত্মগোপনের আদর্শ সময় নাকি রাতের অন্ধকার- একটু বুদ্ধি খাটালেই সেটা বোঝা যায়।

কোরআনের আয়াতগুলোকে, যাকে আল্লাহ বলেছেন সর্বোত্তম হাদিস (৩৯:২৩), সেগুলিকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব সেটা নিঃসন্দেহে যার যার ব্যক্তিগত দায়িত্বের ব্যাপার। আমাদের কোন কাজের দায় কোন পীর, ইমাম বা আমাদের পূর্বপুরষরা যে নেবেন না সেটা কোরানে পরিস্কার করে বলা আছে।

ইফতারের প্রসঙ্গে অনেকে হাদিসের রেফারেন্স দেন, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রেওয়াজের কথা বলেন। কিন্তু তারা একটা জিনিস ভুলে যান, যে বিষয়ে কোরআনে স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায়, সে বিষয়ে ফায়সালার জন্য হাদিস, ইজমা, কিয়াসের প্রয়োজন হয় না। হাদিস দিয়ে কোরআনের কোন স্পষ্ট নির্দেশকে রদ করা যায় না।

৪৫:৬ এইগুলি আল্লাহর আয়াত, যাহা আমি তোমার নিকট তিলাওয়াত করিতেছি যথাযথভাবে। সুতরাং আল্লাহর এবং তাহার আয়াতের পরিবর্তে উহারা আর কোন বাণীতে (আরবী: হাদিস) বিশ্বাস করিবে।

৭৭:৫০ সুতরাং উহারা কুরআনের পরিবর্তে আর কোন কথায় (আরবী হাদিস) বিশ্বাস করিবে।

কোরআনের আয়াতগুলোকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব সেটা নিঃসন্দেহে যার যার ব্যক্তিগত দায়িত্বের ব্যাপার। আমাদের কোন কাজের দায় কোন পীর, ইমাম বা আমাদের পূর্বপুরুষরা যে নেবেন না সেটা কোরানে পরিস্কার করে বলা আছে।

৬:১১৬ যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথামত চল তবে তাহারা তোমাকে আলস্নাহর পথ হইতে বিচ্যুত করিবে। তাহারা তো শুধু অনুমানের অনুসরণ করে; আর তাহারা তো শুধু অনুমানভিত্তিক কথা বলে।

৩৩:৬৭ তাহারা আরও বলিবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করিয়াছিলাম এবং উহারা আমাদিগকে পথভ্রষ্ট করিয়াছিল;

৯:৩১ তাহারা আল্লাহ ব্যতীত তাহাদের পন্ডিতগণকে ও সংসারবিরাগীগণকে তাহাদের প্রভুরুপে গ্রহণ করিয়াছে এবং মারইয়াম-তনয়-মসীহকেও। কিন্তু তাহারা এক ইলাহের ইবাদত করিবার জন্যই আদিষ্ট হইয়াছিল। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তাহারা যাহা শরীক করে তাহা হইতে তিনি কত পবিত্র!

কোরান পাঠ করে নিজের বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করারই পরামর্শ দেয়া হয়েছে বারবার।

১৭:৩৬ যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নাই উহার অনুসরণ করিও না। কর্ণ, চক্ষু, হৃদয়- উহাদের প্রত্যেকটি সম্পর্কেই কৈফিয়ত তলব করা হইবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top