দিনে দিনে সালামের দৈর্ঘ্য বাড়ছে। আজকাল কেউ আর শুধু সালাম দেন না। আসলালামু আলাইকুমও বলেন না। ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহুর পরেও অনেক দোয়া খায়েরসহ সালাম দেন। কেউ কেউ অবশ্য শুধু সালাম আলাইকুম বলেন। সংক্ষেপে সালাম দিলে অনেকে এ ধরণের সালামের জবাবও দেন না।
সালাম আরবী শব্দ যার অর্থ শান্তি। নবীজী বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করলে শান্তি বা এরকম কোন বাংলা শব্দ, ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করলে পিস বা এরকম কোন ইংরেজি শব্দ বা বাক্য দিয়েই অভিবাদন জানাতেন নিশ্চয়ই। নবীজীর আগের নবী রাসুলরাও (সাঃ) সালাম জানিয়েছেন। সেটা নিশ্চিতই তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায়। (দেখুন ১৪:৪)
৫১:২৪-২৫ আয়াত বা ১৫:৫২ আয়াতে লক্ষ্য করা যাবে ফিরিশতারা এবং ইব্রাহিম (সাঃ) অভিবাদন করতে গিয়ে শুধু ‘সালাম’ শব্দটি ব্যাবহার করেছেন। (নিশ্চিতভাবেই তিনি আরবীতে সালাম বলেননি, তার মাতৃভাষাতেই বলেছিলেন।)
কোরআন শরিফে সালামের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘সালামুন আলাইকুম’ বা শুধু ‘সালাম’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। (দেখুন – ৬:৫৪, ৭:৪৬, ১৩:২৩-২৪, ১৬:৩২, ২৮:৫৫, ৩৯:৭৩ ইত্যাদি)।
আস-সালামু আলাইকম এর ব্যবহার কোরআনের কোথাও নেই। বরং কেউ কেউ দাবি করেন, যেহেতু আল্লাহর আরেক নাম আস-সালাম (৫৯:২৩), সেক্ষেত্রে সালামে এর ব্যবহার না করাই উত্তম।
অনেক হুজুর বা তাদের অনুসারীরা সালাম সম্পর্কে যেটা বলে থাকেন সেটা কিছু হাদিসের উপর নির্ভর করে যার সারসংক্ষেপ: ইহুদীরা নবীজী (সাঃ) এবং সাহাবীদের অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য বলতো আস সামু আলাইকুম’ (স্লামালাইকুম নয়), এর অর্থ তোমার মরণ হোক। তখন নবীজী (সাঃ) সাহাবীদের নির্দেশ দেন তোমরা বিধর্মীদের আগে সালাম দেবে না। ওরা যা বলবে তার জবাবে বলবে ‘ওয়া আলাইকুম’ যার অর্থ দাড়াবে ‘তোমাদের উপরও’। (দেখুন বুখারি ভলিউম ৯, বুক ৮৪, হাদিস নম্বর ৬১ ইত্যাদি, অন্যান্য হাদিসগ্রন্থেও এরকম হাদিস মিলবে। সূত্র http://www.sahih-bukhari.com/Pages/Bukhari_9_84.php)। আরও হাদিসের জন্য https://www.sunnah.com/search/samu
এসব হাদিস খুব নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয় না, এবং কোরআনের সংগে সাংঘর্ষিকও বটে। যে নবীর উপর চরম অত্যাচারের পরও তিনি অত্যাচারীদের অজ্ঞতার জন্য তাদের উপর যেন আল্লাহ রুষ্ট না হন সেজন্য দোয়া করেছেন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, তাদের হেদায়াত দেওয়ার আরজি জানিয়েছেন, সেখানে সামান্য অভিবাদনের ক্ষেত্রে তিনি এমন প্রতিশোধমূলক আচরণ করবেন এবং সেটা করার পরামর্শ দেবেন, এমনটা মনে হয় না। বিশেষ করে কোরআনে যখন বলা হয়েছে যে কোন অভিবাদনের জবাবে উত্তম প্রতিঅভিবাদন জানানোর কথা।
৪: ৮৬ তোমাদেরকে যখন অভিবাদন করা হয় তখন তোমরাও উহা অপেক্ষা উত্তম প্রত্যাভিবাদন করিবে অথবা উহারই অনুরুপ করিবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী।
২৫:৬৩ রাহমান এর বান্দা তাহারাই যাহারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করা এবং তাহাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে, তখন তাহারা বলে `সালাম’।
৪৩:৮৮-৮৯ আমি অবগত আছি রাসুলের এই উক্তি : হে আমার প্রতিপালক! এই সম্প্রদায় তো ঈমান আনিবে না। সুতরাং তুমি উহাদেরকে উপেক্ষা কর এবং বল ‘সালাম’। উহারা শিঘ্রই জানেতে পারিবে।
সুতরাং কেউ যদি শুধু সালাম বা সালাম আলাইকুম বলেন তার জবাব না দেওয়া বা তাকে তিরস্কার করা কি সমীচিন ?
আরবী অর্থের বিচারে সালাম আলাইকুম পুরোপুরি শুদ্ধ হয় কিনা তা আমার জানা নেই। তবে এটুকু ঠিক যে, এর মাধ্যমে কোন মতেই অন্যের ধ্বংস কামনা করা হয় না। বরং আমরা এটা বলে যে সৌজন্য প্রকাশ করতে চাই সে কাজটা হয়। শব্দতো বাহন মাত্র, মনের ভাব প্রকাশ করাই তার কাজ। অনেক সময় ইংরেজি অনেক কথাও আমরা ভুল উচ্চারণে বলি, এমনকি মাতৃভাষা বাংলাও। তাতেও কিন্তু বিশেষ অসুবিধা হয় না। আরবীও আমাদের জন্য একটি বিদেশী ভাষা। এক্ষেত্রে উচ্চারণে সামান্য ক্রটি বিচু্যতি হতে পারে। এটাকে কেউ যদি স্মার্টনেস দেখনোর জন্য করে থাকেন সেটা আলাদা কথা।
সবকিছুরই বিচার তো শেষমেষ আমাদের অন্তরে কী আছে তার উপর, বাহিরের আচরণ নয়। কোরআনেও এমনটা বলা আছে। আর ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশও তো কোরআনে বহুবারই দেওয়া হয়েছে। সালাম নিয়েও বাড়াবাড়ি না করাই ভালো।