৩২:৪ ৪. আল্লাহ,যিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও উহাদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু সৃষ্টি করিয়াছেন ছয় দিনে। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক নাই এবং সুপারিশকারীও নাই; তবু কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করিবে না?
মুসলিমদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করেন শেষ বিচারের দিনে নবীজীর (সাঃ) শাফায়াতে বা সুপারিশে অনেকেই ছাড় পাবেন। খুবই বিপজ্জনক এবং দুঃখজনক এই বিশ্বাস। এক আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের (সুরা ফাতিহা : আমরা একমাত্র তোমরাই এবাদত করি, তোমরাই কাছে সাহায্য চাই।) সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই ভাবনা। এই বিশ্বাস বান্দা এবং স্রষ্ট্রার মাঝে একজন মধ্যস্থতাকারীকে হাজির করে যার বিরোধিতাই করে গেছেন নবীজী তার নবুয়তের ২৩ বছর। কোরানে বহুবার এই ধারণার বিপক্ষে ওহী নাজিল হলেও বিভিন্ন হাদিসের নামে এই শাফায়াতের প্রচারণা চালিয়ে পরনির্ভরশীলতার এক মানসিকতা গড়ে তোলার রেওয়াজ এখনো চলছে।
কোরআনে কোথাও নবীজী (সাঃ) শাফায়াত করবেন একথার সামান্য ইঙ্গিতমাত্রও নেই। পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে বিচারদিবসে কেউ কারো কাজে লাগবে না, যদি না আল্লাহ অনুমতি করেন। আল্লাহ অনুমতি করবেন কি না তা নিশ্চিত করে কোথাও বলা নেই। কে বা কারা, মানুষ না ফেরেশতা না অন্য কেউ এই সুপারিশের সুবিধা পাবেন সে ব্যাপারেও সুষ্পষ্ট কোন কথাই নেই। কিন্তু তবু নবীজীকে শাফায়াতের একমাত্র অধিকারী বলে প্রচার করছেন অনেকে।
নিচের আয়াত দুটো লক্ষ্য করুন।
৮২:১৭-১৯ কর্মফল দিবস সম্পর্কে তুমি কী জান? আবার বলি, কর্মফল দিবস সম্পর্কে তুমি কী জান? সেই দিন একে অপরের জন্য কিছু করার থাকবে না। এবং সেদিন সমস্ত কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর।’
৪৬:৯ বল, Èআমি কোন নতুন রসুল নই। আমি জানি না আমার ও তোমাদের ব্যাপারে কী করা হবে। আমি আমার প্রতি যা ওহী করা হয় কেবল তারই অনুসরণ করি। আমি তো এক স্পষ্ট সতর্ককারীমাত্র।’
৭:১৮৮ বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের উপরও আমার কোন অধিকার নাই। আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম তবে তো আমি নিজের জন্য অনেক কল্যান করে নিতাম, এবং কোন অকল্যানই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মুমিনদের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আর কিছু নই।’
৬:৫০ বল, Èআমি তোমাদের বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধনভান্ডার আছে, অদৃশ্য সম্বন্ধেও আমি অবগত নই। এবং তোমাদের এটাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমার প্রতি যাহা ওহী হয় আমি শুধু তাহারই অনুসরণ করি।’
১০:৪৯ বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভালো-মন্দের উপর আমার কোন অধিকার নাই।’
৭:২৫ বল, আমি জানি না, তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা কি আসন্ন, না আমার প্রতিপালক এর জন্য কোন দীর্ঘ মেয়াদ স্থির করবেন?’
আরও অনেক আয়াতে এসব আয়াতেরই নির্যাস আছে।
৩৯:১৯ যার উপর দন্ডাদেশ অবধারিত হয়ে আছে, তুমি কি রক্ষা করতে পারবে সেই ব্যক্তিকে যে জাহান্নামে আছে?’
শাফায়াতের এখতিয়ার থাকবে কেবল আল্লাহর হাতে।
সুপারিশের আরবী শব্দ শাফাআ।
২:৪৮ তোমরা সেইদিনকে ভয় কর যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না। কারো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না, কারো কাছ থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ করা হবে না, এবং তারা কোন প্রকার সাহায্যও পাবে না।’
২:১২৩ এবং তোমরা সেই দিনকে ভয় করো যেদিন কেউ কারো কোন উপকারে আসবে না, কারো কাছ থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ করা হবে না, এবং কোন সুপারিশ কারো পক্ষে লাভজনক হবে না, এবং তারা কোন সাহায্যও পাবে না।
২:২৫৪ হে মুমিনগণ! আমি তোমাদের যা দিয়েছি তা থেকে তোমরা ব্যয় করো সেই দিন আসার আগে যেদিন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না এবং কাফিররাই জালিম।
একই কথা বলা আছে আয়াতুল কুরসী নামে বহুল পঠিত আয়াতেও। (২: ২৫৫)
কে সুপারিশের অধিকারী হবেন, আদৌ হবেন কি না কোথাও কিন্তু তা নিশ্চিত করে বলা হয়নি।
আল্লাহর কোন মধ্যস্থতাকারী প্রয়োজন নেই, এটাই ইসলামের মৌলিক একটি শিক্ষা।
৬:৫১ তুমি এদ্বারা তাদের সতর্ক করে দাও যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের কাছে সমবেত করা হবে এমন অবস্থায় যে, তিনি ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক বা সুপারিশকারী থাকবে না: হয়ত তারা সাবধান হবে।’
আরও অনেক আয়াত- ১০:৩, ৪৩:৮৬, ১৯:৮৭, ৩৯:৪৪, ৩২:৪, ২১:২৮, ৪০:১৮…।
অনেকে নবীজীর শাফায়াতের প্রমাণ হিসেবে নিচের আয়াতটি উদ্ধৃত করেন।
৪:৬৪ রাসুল এই উদ্দেশ্যেই পাঠিয়েছি যে আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তার আনুগত্য করা হবে। যখন তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করে তখন তোমার কাছে এলে এবং আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং রসুলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইলে তারা অবশ্যই রাসুলকে পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালুরুপে পাবে।’
এই আয়াতে কিন্তু শাফায়াতের কোন কথা নেই। এটা এই পৃথিবীর ঘটনা, বিচার দিবসের নয়। কনটেক্সট থেকে বিচ্ছিন্ন করে আয়াতটিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এর ঠিক আগের আয়াতগুলির প্রেক্ষাপটে এটিকে বিবেচনা করলে বিষয়টি পরিস্কার হবে যে, এখানে নবীজীর সমসাময়িক মুনাফিকদের লক্ষ্য করে বলা হচ্ছে, যদি তারা নবীজীকে মেনে চলে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় এবং নবী যদি তাদের জন্য ক্ষমা চান তাহলে তারা ক্ষমা পাবে। কিন্তু মুনাফিকরা তা করেনি। সুতরাং ওই হাইপোথিটিকাল পরিস্থিতির উদাহরণ টেনে শাফায়াতের প্রমাণ করা যায় না।
অন্যদিকে একটি আয়াতের কথা বলা যায় যেখানে জোর দিয়ে তার ক্ষমা চাওয়ার বা শাফায়াতের গুরুত্বহীনতার কথা বলা হয়েছে। রসুল ক্ষমা চাইলেই যে ক্ষমা মিলবে না সেটা বেশ জোর দিয়েই বলা হয়েছে এ আয়াতে।
৯:৮০ তুমি ওদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো বা না করো একই কথা। তুমি সত্তর বার ওদের জন্য ক্ষমা চাইলেও আল্লাহ ওদের কখনোই ক্ষমা করবেন না। কারণ ওরা আল্লাহ ও রাসুলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যারা পাপাচারী আল্লাহ তাদের পথ প্রদর্শন করেন না।’
এ আয়াতটি থেকে খুব পরিস্কারভাবেই বোঝা যায় যে, ৪:৬৪ আয়াতটি কন্ডিশনাল।
এটাও খুব মনে রাখা দরকার যে, এমনকি নিজের পরমাত্মীয়দের ক্ষেত্রেও (যদি তারা নিশ্চিত মুশরিক ও কাফির হয়ে থাকেন) ক্ষমাপ্রার্থনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছে সকল মুমিনদের এবং নবীদেরও।
৯:১১৩ আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য সংগত নয়, যখন এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, নিশ্চিত তারা জাহান্নামী।’
নবীর ক্ষমা প্রার্থনা যে কোন কাজে আসবে না সে ব্যাপারে আরো দুটি আয়াতে পরিস্কার করে বলা হয়েছে। ৪:৪৬ এর সাথে মিলিয়ে পড়তে পারেন। থিমটা একইরকম। সেখানে বলা হয়েছে যে অবিশ্বাসীরা নবীর কাছে আসবে না এবং/অথবা তারা ক্ষমা পাবে না।
৬৩:৫ যখন তাদের বলা হয়, আসো, আল্লাহর রসুল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন তখন তারা মাথা ঘুরিয়ে নেয়, এবং তুমি ওদের দেখতে পাও। ওরা দম্ভভরে ফিরে যায়।’
৬৩:৬ তুমি ওদের জন্য ক্ষমা চাও বা না চাও, দুটোই ওদের জন্য সমান। আল্লাহ তাদের কখনো ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।’
এ আয়াতও নবীজীর সমসাময়িক সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে। এর সাথে বিচার দিবসের শাফায়াতের কোন সম্পর্ক নেই।
উম্মতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি যে শুধু নবীজীর জন্যই প্রযোজ্য তা নয়, নিচের আয়াতে দেখা যাচ্ছে ইব্রাহিম (সাঃ) বিচার দিবসে যেন সকল বিশ্বাসীদের ক্ষমা করা হয় তার প্রার্থনা করেছেন।
১৪:৪১ হে আমাদের প্রতিপালক! যেদন হিসাব অনুষ্ঠিত হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং মুমিনগণকে ক্ষমা করো।’
তার পরে তার সম্প্রদায় নিয়ে কী হবে সে ব্যাপারে তার অজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ঈসা (সাঃ) ৫ নম্বর সুরার ১১৬-১১৭ আয়াতে। সেখানেও তার নিজের যে অন্যের ভাল-মন্দ করার কোন ক্ষমতা নেই তা স্পষ্ট করেছেন তিনি।
আরো অনেক সুরার মতো ৮২ নম্বর সুরার ১৭-১৯ নম্বর আয়াতে পরিস্কার করে বলা হয়েছে এ ব্যাপারে।
শেষ নবীর শাফায়াতের ধারণা হাদিসপ্রসুত। কোরআনে এর কোন প্রমাণ নেই।
পরিশেষে,
সুপারিশ করার ক্ষেত্রে জরুরী বিষয় হলো জানাশোনা। আমি যার সম্পর্কে কিছুই জানিনা, তার সম্পর্কে কোন সুপারিশ করা সম্ভবই নয়। নবীজী (সাঃ) হয়তো তার সমসাময়িকদের সম্পর্কে সুপারিশ করতে পারেন, যাদের সম্পর্কে তার কম-বেশি ধারণা আছে। কিন্তু তার ওফাতের পর আর কারো সম্পর্কে তার জানার কথা নয়, সে হিসেবে সুপারিশের বিষয়টিও অবান্তর।
নবী-রাসুল বা অন্য কোন গোষ্ঠীর ব্যাপারে না বললেও, ফেরেশতাদের সুপারিশের ব্যাপারে একটি দুটি আয়াত রয়েছে কোরআনে যা থেকে মনে হয়, সুপারিশের সুবিধাটা তারা পাবেন, যা যুুক্তিসঙ্গতও মনে হয়। কারণ আমাদের সঙ্গী ফেরেশতারা আমাদের আমল দেখছেন সেগুলো লিপিবদ্ধ করছেন। ফলে আমাদের সম্পর্কে তারা সুপারিশ করতে পারেন।
২১: ২৭-২৮ তাহারা(ফেরেশতারা) আগে বাড়িয়া কথা বলে না; তাহারা তো তাঁহার আদেশ অনুসারেই কাজ করিয়া থাকে। তাহাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যাহা কিছু আছে তাহা তিনি অবগত। তাহারা সুপারিশ করে শুধু উহাদের জন্য যাহাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট এবং তাহারা তাঁহার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত।
৫২:২৬ আকাশে কত ফিরিশতা রহিয়াছে; উহাদের সুপারিশ কিছুমাত্র ফলপ্রসু হইবে না, তবে আল্লাহর অনুমতির পর; যাহার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন ও যাহার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।
তবে ফেরেশতাদের সুপারিশও সম্ভবত কাজে আসবে না। কারণ, তারা শুধু আমাদের আমল দেখেন, আমাদের অন্তঃকরণের খবর তারা রাখেন না। সে খবর জানেন শুধু আল্লাহ। ফলে সার্বিক বিচারে তাদের সুপারিশও কার্যকর কিছু হবে না।
এবং, কাজেকাজেই, সেদিন আল্লাহর ঘোষণামাফিক কারো কোন সুপারিশই কাজে আসবে না।