শুরুতেই এটা জেনে নেওয়া ভালো যে, রুহ সম্পর্কে আমাদের খুব বেশি কিছু জানার সুযোগ নেই। এর প্রকৃতি কী তা আল্লাহ গোপন রেখেছেন। (যেমন কেয়ামত সম্পর্কে আমরা কিছু জানতে পারি না।) নিচের আয়াতটি থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে কোরআনে রুহ বা আত্মার বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি
১৭:৮৫ তোমাকে উহারা রুহ (আরবী রুহি) সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, রুহ আমার প্রতিপালকের আদেশঘটিত (আরবী রুহ মিন-আমর) এবং তোমাদিগকে জ্ঞান দেওয়া হইয়াছে সামান্যই।
কোরআনে রুহ (আত্মা) শব্দটি দুভাবে ব্যবহার করা হয়েছে:
১. পবিত্র আত্মা হিসেবে রুহ
২. ঐশ্বরিক শক্তি হিসেবে রুহ
কোরআনের আয়াত থেকে আমরা সহজেই জানতে পারি যে রুহ (আত্মা) এবং মালাইকা (ফেরেশতা) দুটো আলাদা সত্তা।
৭৮:৩৮ সেই দিন রুহ (আরবী রুহু) ও ফিরিশতাগণ (আরবী মালাইকাতু) সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াইবে; দয়াময় যাহাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত অন্যেরা কথা বলিবে না এবং সে যথার্থ বলিবে।
৭০:৪ ফিরিশতা (আরবী মালাইকাতু) এবং রূহ (আরবী রুহু) আল্লাহর দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন এক দিনে যাহার পরিমাণ পার্থিব পঞ্চাশ হাজার বত্সর।
৯৭:৪ সেই রাত্রিতে ফিরিশতাগণ (আরবী মালাইকাতু) ও রূহ(আরবী রুহু) অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাহাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।
১. পবিত্র আত্মা হিসেবে রুহ (রুহুল কুদুস)
লক্ষণীয় কোরআনে কোথাও জিব্রাইলকে ফেরেশতা (মালাইকা) হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। উপরন্তু, কোরআনে জিব্রাইলকে রুহুল কুদুস (রুহ আল-কুদুস) এর সমার্থক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৬:১০২ বল, তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে রুহুল কুদুস (আরবী রুহ আল-কুদুস) জিবরাইল সত্যসহ কুরআন অবতীর্ণ করিয়াছে, যাহারা মুমিন তাহাদিগকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য এবং হিদায়াত ও সুসংবাদস্বরুপ মুসলিমদের জন্য।
২:৯৭ বল, যে কেহ জিবরীলের শত্রু এইজন্য যে সে আল্লাহর নির্দেশে তোমার হূদয়ে কুরআন পৌছাইয়া দিয়াছে, যাহা উহার পূর্ববর্তী কিতাবের সমর্থক এবং যাহা মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও শুভ সংবাদ-
পরের আয়াতটি পাঠে এটা মনে হয় যে, রুহ আল-ক্বুদুসকে রুহ আল-আমীন হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে।
২৬:১৯২-১৯৩ নিশ্চয়ই আল কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালক হইতে অবতীর্ণ। জিবরাঈল (আরবীতে রুহ আল-আমিন) ইহা লইয়া অবতরণ করিয়াছে।
(* এটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ। এখানে সরাসরি জিবরাইল টার্মটিই ব্যবহার করা হয়েছে এবং ফুটনোটে বলা হয়েছে- ‘এস্থলে রুহুল আমিন দ্বারা জিবরাঈলকে বুঝাইতেছে।)
পবিত্র আত্মা বা রুহ আল-কুদুসকে ঈসা (সাঃ)কে শক্তিশালী করার জন্যও প্রেরণ করা হয়েছে।
২:৮৭ (অংশবিশেষ) এবং নিশ্চয়ই আমি মূসাকে কিতাব দিয়াছি এবং তাহার পরে পর্যায়ক্রমে রাসুলগণকে প্রেরণ করিয়াছি, মারইয়াম-তনয় ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণ দিয়াছি এবং পবিত্র আত্মা (রুহ আল-কুদুস) দ্বারা তাহাকে শক্তিশালী করিয়াছি। …
২:২৫৩ (অংশবিশেষ) … মারইয়াম-তনয় ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করিয়াছি ও পবিত্র আত্মা দ্বারা তাহাকে শক্তিশালী করিয়াছি।…
৫:১১০ (অংশবিশেষ) স্মরণ কর, আল্লাহ বলিবেন, হে মারইয়াম-তনয় ঈসা! তোমার প্রতি ও তোমার জননীর প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ করঃ পবিত্র আত্মা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করিয়াছিলাম…
এটাও সহজে অনুমেয় যে, যিনি নিখুঁত মানবাকৃতিতে মরিয়মের নিকট হাজির হয়েছিলেন তিনিও রুহ আল-কুদুস বা পবিত্র আত্মা।
১৯:১৭ অতঃপর উহাদিগ হইতে সে পর্দা করিল। অতঃপর আমি তাহার নিকট আমার রুহকে (আরবী রুহানা) পাঠাইলাম, সে তাহার নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করিল।
(আরবীতে রুহানা অর্থ আমাদের রুহকে হলেও ইফার অনুবাদে আমার রুহকে লেখা হয়েছে। তাতে ভাবার্থের কোন ব্যতয় হয় না। এখানে বহুবচনটি সম্মানবাচকার্থে ব্যবহৃত)
২. ঐশ্বরিক শক্তি হিসেবে রুহ – তাঁর আদেশের ভাব/মর্ম/উদ্দীপনা
ঐশ্বরিক শক্তি হিসেবে যে রুহ তার আবার দুটি ধরণ রয়েছে বলে মনে হয়।
ক. আদেশ বা আজ্ঞা আকারে ঐশ্বরিক শক্তি (রুহ মিন আমর)
খ. বিশেষ গুণান্বিত জীবন গঠনের জন্য যে ঐশ্বরিক শক্তি ফুত্কার করে দেওয়া হয় (মিন রুহ)
এটা সম্ভব যে এই দুই ধরণের রুহই আসলে সমার্থক। অর্থাৎ জীবন গঠনের জন্য ঐশ্বরিক শক্তির কথা বলা হচ্ছে সেটা ঐশ্বরিক আদেশেরই অংশ। এখানে আমরা দুটিকে আলাদা করেই বিচার করবো।
আদেশ হিসেবে ঐশ্বরিক শক্তি হিসেবে-
১৬:২ তিনি তাঁহার বান্দাদের মধ্যে যাহার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশ (আরবী রুহি মিন আমরিহি) ওহীসহ ফিরিশতা প্রেরণ করেন এই বলিয়া যে, তোমরা সতর্ক কর যে, নিশ্চয়ই আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই; সুতরাং আমাকেই ভয় কর।
৪০:১৫ তিনি সমুচ্চ মর্যাদার অধিকারী, আরশের অধিপতি, তিনি তাঁহার বান্দাদের মধ্যে যাহার প্রতি ইচ্ছা ওহী প্রেরণ করেন স্বীয় আদেশসহ (আরবী রুহি মিন আমরিহি), যাহাতে সে সতর্ক করিতে পারে কিয়ামত দিবস সম্পর্কে।
৪০:৫২ এইভাবে আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করিয়াছি রুহ (আরবী রুহি মিন আমরিহি) তথা আমার নির্দেশ; তুমি তো জানিতে না কিতাব কি এবং ঈমান কি! পক্ষান্তরে আমি ইহাকে করিয়াছি আলো যাহা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাহাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করি; তুমি তো প্রদর্শন কর কেবল করল পথ-
জীবন গঠনের জন্য ঐশ্বরিক শক্তি হিসেবে-
১৫:২৯ যখন আমি উহাকে সুঠাম করিব এবং উহাতে আমার পক্ষ হইতে রুহ (আরবী মিন রুহি) সঞ্চার করিব তখন তোমরা উহার প্রতি সিজদাবনত হইও,
৩২:৯ পরে তিনি উহাকে করিয়াছেন সুঠাম এবং উহাতে ফুঁকিয়া দিয়াছেন তাঁহার রুহ হইতে (আরবী মিন রুহিহি) এবং তোমাদিগকে দিয়াছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ, তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
নিচের আয়াতটি থেকে এটা মনে হয় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে রুহ মুমিনদের অন্তকরণকে শক্তিশালীও করে থাকে। অবশ্য এখানে রুহ বলতে আল্লাহর ঐশ্বরিক শক্তি তার আদেশ হিসেবে নাকি পবিত্র আত্মার সমার্থক হিসেবে [যেমনটা ২:৮৭ আয়াত অনুসারে ইসা (সাঃ) এর ক্ষেত্রে] ব্যবহৃত হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
৫৮:২২ (অংশবিশেষ) … ইহাদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করিয়াছেন ঈমান এবং তাহাদিগকে শক্তিশালী করিয়াছেন তাঁহার পক্ষ হইতে রূহ দ্বারা (আরবী রুহি মিনহু)। তিনি ইহাদিগকে দাখিল করিবেন জান্নাতে, যাহার পাদদেশে নদী প্রবাহিত …
মোদ্দাকথায়, কোরআনের আয়াতের আলোকে রুহ দুই ধরণের। একটি পবিত্র আত্মা (রুহ আল-ক্বুদুস) ও অন্যটি ঐশ্বরিক শক্তি যা তার আদেশকে অন্তর্ভূক্ত করে (রুহ মিন-আমর/ মিন রুহি)। এর বাইরে রুহ সম্পর্কে আমাদের কাছে আর কোন তথ্য নাই।