অনেকে মনে করেন, ইসলামে মূর্তি/ভাস্কর্য/চিত্র তৈরি নিষেধ, যে ঘরে মূর্তি/চিত্র রাখা হয় সেখানে ফেরেশতা প্রবেশ করে না ইত্যাদি। সম্ভবত এ কারণে মুসলিম বলে পরিচিত অনেক দেশে ভাস্কর্য, চিত্রকলা ইত্যাদির বিকাশ নেই বললেই চলে।
কোরআনে অবশ্য কোথাও মূর্তি বা ভাস্কর্য বা চিত্রকলা সম্পর্কে কোন বিরুপ মন্তব্য চোখে পড়ে না। তবে মূর্তি পূজা সম্পর্কে কঠোর হুশিয়ারি রয়েছে। একই হুশিয়ারি রয়েছে, গাছপালা, চন্দ্র সূর্য ইত্যাদি যে কোন কিছুর পূজার বিরুদ্ধেও।
কোরআনের ২১ নম্বর সুরায় বলা হচ্ছে :
আমি তো এর আগে ইবরাহিমকে সত্পথের জ্ঞান দিয়েছিলাম এবং আমি তার সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক পরিজ্ঞাত। যখন সে তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বলল, Èএই মূর্তিগুলো কী যাদের পূজায় তোমরা রত আছো?’ (২১:৫১-৫২)
এখানে মূর্তিগুলো বলতে আরবীতে তামাছিল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ মূর্তি/ভাস্কর্য। শব্দটি ছবিসহ যে কোন ধরনের প্রতিরুপের বেলায়ও প্রযোজ্য।
কোরআনের বর্ণনার সাথে যারা পরিচিত তাদের মনে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে। মূর্তি যদি হারামই হবে তাহলে নবী সোলায়মান (সাঃ) কেন মূর্তি নির্মান করাতেন? নিচের আয়াতটি লক্ষ্য করুন।
৩৪:১৩ উহারা (জিনেরা) সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, মূর্তি/ভাস্কর্য, (আরবী তামাছিল) হাওযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ নির্মান করত। আমি বলেছিলাম, হে দাউদ পরিবার, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে কাজ করতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ।’
একজন নবী কেন মূর্তি নির্মাণের নির্দেশ দেবেন যদি সেটা নিষদ্ধিই হবে। উপরন্ত আয়াত থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে এ কাজে আল্লাহর অনুমোদনও ছিল।
উপরের উদাহরণ দুটো থেকে বোঝা যায়, ভাস্কর্য বা মূর্তির ভিতরে কোন সমস্যা নেই, অর্থাত্ মূর্তি হারাম নয়। কোরআন যেটাকে হারাম করেছে তাহলো মূর্তিকে পূজা করা।
অনেকে বলেন, এক এক নবীর সময় এক এক রকম শরীয়া ছিল। সোলায়মান (সাঃ) এর সময়ে হয়তো এটা বৈধ ছিল, এখন আর তা নেই। কোরআনের যে কোন সাধারণ পাঠকও বুঝবেন, এই যুক্তিতে কোন সারবত্তা নেই। কারণ, অতীত নবীদের কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে সবসময়ই মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে কোরআন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বারবার। তাছাড়া, হযরত ইব্রাহিম (সাঃ) হযরত সোলায়মানের পূর্বসূরী। ইব্রাহিম (সাঃ) এর সময় যে জিনিস নিষদ্ধি ছিল, পরে সোলায়মান (সাঃ) এর সময় সেটি বৈধ করে, আবার পরের নবীদের বেলায় তা নিষদ্ধি করা হয়েছে- যুক্তি হিসেবে এটাও ঠিক গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে মূর্তির মতো একটি গুরুতর বিষয়ে, ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতির ভিত্তিতে সদ্ধিান্ত নেয়া হয়েছে বলে মনে করার কোন কারণ নেই।
উপরন্তু, কোরআনে যেখানে বারবার বলা হয়েছে যে ধর্মের বাণী সব নবীর ক্ষেত্রে একইভাবে প্রেরিত হয়েছে। তাতে কোন ভিন্নতা নেই। (৪২:১৩ ও অন্যান্য)।
মুহম্মদ (সাঃ) কে এমন কোন নতুন কথা বলা হয়নি যা আল্লাহ আগের নবীদের বলেননি। (৪১:৪৩)
কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ তা কোরআনেই পরিস্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে। এবং বিশ্বাসীদের উপদেশ দেয়া হয়েছে আল্লাহ যা বৈধ করেছেন তা যেন তারা অবৈধ না করে।
হে মুমিনগণ, আল্লাহ যেসব উত্তম বস্তু তোমাদের জন্য হালাল করেছেন তা তোমরা হারাম করো না। এবং সীমালংঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না। (৫:৮৭)
১৬:১১৬ আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার জন্য তোমরা বলো না, Èউহা হালাল এবং উহা হারাম।’ নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে তারা সফল হবে না।
৭:৩২ বল, Èআল্লাহ তার বান্দাদের জন্য যেসব শোভাময় বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে?’
এখানে এটাও উলে্লখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বৈধ একটি বিষয়কে অবৈধ বলায় কোরআনে নবীজীকেও (সাঃ) সতর্ক করা হয়েছে।
৬৬:১ হে নবী! আল্লাহ যা তোমার জন্য বৈধ করেছেন তুমি তা নিষদ্ধি করছো কেন? তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাচ্ছ। কিন্তু আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’
বিশ্বাসীদের জন্য ধর্মীয় বিষয়ে বৈধ অবৈধের ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রেরিত কোরআনই চূড়ান্ত ফায়সালা।
৬:১১৪ বল, Èতবে কি আমি আল্লাহ ছাড়া অন্যকে শালিস মানব যদিও তিনিই তোমাদের প্রতি সুষ্পষ্ট কিতাব অবতীর্ণ করেছেন,’ আমি যাদের কিতাব দিয়েছি তারা জানে যে, উহা তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে সত্যসহ অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তুমি সন্দিহানদের অন্তভর্ূক্ত হয়ো না।
কোরআনে আল্লাহ একাধিকবার এটিকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত গ্রন্থ বলেছেন। (৬:১১৪, ১২:১১১ ইত্যাদি) ফায়সালার ক্ষেত্রে একমাত্র সোর্স হিসেবে বর্ণনা করেছেন একে। (৭:১৮৫, ৩১:৬-৭, ৪৫:৬, ৬৮:৩৬-৩৮, ৭৭:৫০ ইত্যাদি) তাহলে কী হারাম আর কী হালাল সেটা বিবেচনার ক্ষেত্রেও কোরআনকেই মান্য করে চলা উচিত।
মূর্তির প্রসঙ্গটি একইভাবে বিস্তারিত হতে পারে চিত্রকলা, সঙ্গীত ইত্যাদি ক্ষেত্রেও। কোরআনে কোথাও শিল্পকলার এসব মাধ্যমকে অবৈধ বলা হয়নি। কীভাবে আমরা তার চর্চা করছি সেটিই মূখ্য বিষয়।
মূলত, মূর্তি, চিত্রকলা ইত্যাদির নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জোরালোভাবে আছে সেকেন্ডারি সোর্স হাদিসের বইগুলোতে, যেখানে অনেক পরষ্পরবিরোধী হাদিসের দেখা মেলে। একারণে সকল হাদিসই কোরআনের আলোকে যাচাই করে নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
মুর্তি ও চিত্রকলা বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি নবীর অনুমোদনসূচক হাদিসও আছে। যেমন নবীজায়া হযরত আয়েশা ঘোড়ার মুর্তি বানিয়ে খেলছেন এবং তা নিয়ে কথা বলছেন নবীজীর (সাঃ) সঙ্গে, তিনি হাসছেন তা দেখে। (আবু দাউদ, বুক ৪১, হাদিস নং ৪৯১৪) আবার স্বপ্নে একটি রেশম বসে্ত্র আয়েশার অঁাকা ছবি দেখার কথা উলে্লখ করেছেন নবীজী (সাঃ) নিজেই, এবং এ ব্যাপারে কোন অসনে্তাষ দেখা যায়নি তার মধ্যে। (সহীহ বুখারি ভলিউম ৫, বুক ৫৮ হাদিস নং ২৩৫)। দরজা জানালার পর্দায় ছবি অঁাকা থাকবে কী না তা নিয়ে রয়েছে পরষ্পরবিরোধী হাদিসও। (দেখুন সহীহ বুখারি ভলিউম ৭ বুক ৭২ হাদিস নং ৮৪১ এবং সহীহ বুখারি ভলিউম ৭ বুক ৭২ হাদিস নং ৮৩৯)। আবার অনেক হাদিসে Èগাছের প্রাণ নেই’ এই ধারণা থেকে গাছের ছবি অঁাকাকে বৈধ বলা হয়েছে।
পাঠসূত্র :
http://quransmessage.com/…/Are%20Statues%20and%20Images…
http://quransmessage.com/articles/music.htm