প্রত্যেক মুসলিম শিশুর/পুরুষের খৎনা করা জরুরী বলে আমরা অধিকাংশ মুসলিম বিশ্বাস করি। নারী লোকের কি হয় বিধান? লালনের এই প্রশ্নের জবাব কারো কাছে নেই। তবে আফ্রিকার কিছু দেশসহ বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশে নারী খৎনার নামেও এক অনাচার চালু আছে। ধর্মগ্রন্থে অর্থাত্ কোরআনে এই খৎনার ব্যাপারে কিছু বলা আছে কিনা এ নিয়ে আমরা কেউ প্রশ্ন তুলি না। পরিবর্তে অন্ধের মতোই এই কর্মটি পুরুষানুক্রমে করে যাচ্ছি।
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে চিকিত্সকের সঙ্গেও পরামর্শ করি না।
খৎনার স্বাস্থ্যগত উপকারিতার বিষয়টি চিকিত্সাশাস্ত্রে এখনো বিতর্কিত। ক্ষেত্রবিশেষে এর উপকারিতা এবং প্রয়োজীনতা থাকতে পারে। কিন্তু আলোচনার বিষয়, খৎনা মুসলমান হওয়ার জন্য কি আদৌ জরুরী? এটি কি কোন ধর্মীয় বিধান? কোরআনে কি এ সম্পর্কে সামান্য ইঙ্গিতও আছে?
উত্তর হলো, না।
পরিবর্তে এমন আয়াত অনেক আছে যেখানে আল্লাহ বলেছেন যে তিনি মানুষকে নিখুঁত করে তৈরি করেছেন। ফলে কাটাছেড়া করে এটার পরিবর্তন অপরিহার্য, এ ধারণা কোরআনসম্মত নয়।
৩২:৭-৯ যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন (আরবী আল্লাজী আহসানা কুল্লা শায়্যিন খালাক্বু) এবং কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে। অতঃপর তিনি তাকে সুষম (আরবী সাওয়াহু) করেন, তাতে রুহ সঞ্চার করেন এবং তোমাদেরকে দেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তকরণ। তোমরা সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
৪০:৬৪ ..এবং তিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করিয়াছেন এবং তোমাদের আকৃতি করিয়াছেন সুন্দর। (অংশবিশেষ)
৩৮:৭২ যখন আমি উহাকে সুষম করিব এবং উহাদে আমার রুহ সঞ্চার করিব, তখন তোমরা উহার প্রতি সিজদাবনত হইও।
৮২:৭ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করিয়াছেন এবং সুসমঞ্জস করিয়াছেন।
৯১:৭ শপথ মানুষের এবং তাঁহার যিনি উহাকে সুঠাম করিয়াছেন।
৯৫:৪ আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সর্বোত্তম (আরবী তাক্বওয়িমিম) অবয়বে।
আরবী সাওয়াহু এসেছে সিন ওয়া ইয়া শব্দমূল থেকে। এর অর্থ কোন কিছুকে নিখুঁত করা, কোন কিছুকে সঠিক অবস্থায় পৌছে দেওয়া। এর ক্রিয়া ফর্ম ‘সাওয়্যা’র অর্থও বিভিন্ন অংশের সুষমতা, পরিপূর্ণতা, সমতলকরণ ইত্যাদি।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আল্লাহ যখন মানুষকে সুসমঞ্জস, পরিপূর্ণ করেই, সর্বোত্তম অবয়বে তৈরি করেছেন তখন কেন পুরুষ মানুষকে খানিকটা ত্বক ছেদন করে শুদ্ধ হতে হবে, যেখানে কোরআনে কোথাও এ ধরণের কোন কিছুর কথা বলা হয়নি।
বস্তুত, খৎনা চর্চার একমাত্র সূত্র হলো ‘সুন্না’। বলা হয়, হযরত ইব্রাহিম (সাঃ) এর সময় থেকে এই চর্চা চলে আসছে। কিন্তু কোরআনে কোথাও ইব্রাহিম (সাঃ) এর খৎনার প্রসঙ্গ নেই। এটি এসেছে বাইবেল থেকে। (আদিপুস্তক ১৭:১৪, ১৭:২৪, ১৭:২৫, যাত্রাপুস্তক ৪:২৫)।
ধারণা করা যায় বাইবেলের সূত্রে হাদিসেও ইব্রাহিমের (সাঃ) খৎনার কথা এসেছে। বাইবেলে ৯৯ বছরে এই খৎনা করার কথা বলা হয়েছে, আর বুখারি শরিফে বলা হয়েছে ৮০ বছর বয়সের কথা।
অন্য অনেক ক্ষেত্রে বাইবেলকে ক্রটিপূর্ণ গ্রন্থ বললেও অনেক মুসলিম খৎনার ক্ষেত্রে বাইবেলকে প্রমাণ হিসেবে হাজির করেন।
উল্লেখ্য অনেক খৃস্টানই খৎনাকে আবশ্যিক ধর্মীয় আচার বলে মনে করেন না। ইহুদীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নবীজীর (সাঃ) সমসাময়িক বা অব্যবহিত পরের আরবের চর্চাও এ বিষটিকে সমর্থন করে না। বরং প্রথম দিকের মুসলিমরা খৎনা প্রথার বিরোধিতাই করেছেন। পুরো হাদিস শরিফ ঘেঁটেও নবীজী (সাঃ) এর সমসাময়িক কোন বিখ্যাত বা অখ্যাত, বয়স্ক বা অল্প বয়সী সাহাবীদের খৎনার কোন বিবরণ মেলে না। মুসলিম হওয়ার ক্ষেত্রে যদি এতোই গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে এ সংক্রান্ত একাধিক বিবরণই থাকার কথা সেখানে।
খৎনা সংক্রান্ত যে গুটিকতক হাদিস আছে সেখানে দেখা যায়, আবু হোরায়রা বর্ণিত হাদিসগুলোতেই কেবল নবীজীর (সাঃ) জবানীতে খৎনাকে ফিতরাতের অন্তর্ভূক্ত বলা হয়েছে (বুখারি শরিফ নবম খন্ড পোশাক পরিচ্ছদ অধ্যায় ৫৪৭১)। কিন্তু ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদিসে ফিতরাতের তালিকায় খৎনার কোন উল্লেখ নেই (বুখারি শরিফ নবম খন্ড পোশাক পরিচ্ছদ অধ্যায় ৫৪৭০)।
নবীজীর প্রথম জীবনীকার ইবনে ইসহাক (মৃত ৭৬৭) কিংবা তার সম্পাদক ইবনে হিশাম (মৃত৮৩৮) কেউই নবীর (সাঃ) খত্নার প্রসঙ্গে কোন তথ্যই দেননি। নবীর জন্মকালীন বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিলেও এ প্রসঙ্গে তারা নিরব।
হাসান আল বসরী (জন্ম ৬৪২) মদীনায় জন্ম নেওয়া মুসলিম আলেম। তিনি বলেছেন, নবীজীর সময়ে বিভিন্ন গোত্র বর্ণ থেকে অজস্র মানুষ মুসলমান হয়েছে। কেউ তাদের কাপড়ের তলে তাকিয়ে দেখতে যায়নি তারা খৎনা করেছে কি করে নাই। (সূত্র: ইবনে-ক্বুদুমাহ এন.ডি. ১:৮৫)
ইবনে হাম্বল তার আল মুসনাদে বলেছেন, ‘উসমান ইবনে আবি-আল-আসকে খৎনা করার জন্য ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সে আহ্বান উপেক্ষা করেছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেন: মোহাম্মদের সময়ে আমরা খৎনার কোন আচার করিনি এবং এরকম কাজে আমাদের কেউ ডাকেওনি। (ইবনে হাম্বল ১৯৯৮ ৪:১২৭)
ঐতিহাসিক ও কোরআনের বিখ্যাত ভাষ্যকার আল তাবারি মারা গেছেন ৯২৩ সালে। তিনি জানান, খলিফা উমর ইবনে আদ-আজিজ (মৃত ৭২০) তার খোরাসান বিজয়ী সেনাপ্রধান আল জাররাহ ইবনে আবদুল্লাহর (মৃত ৭৩০) কাছে লিখেছিলেন, ‘যারা তোমার সঙ্গে মক্কাকে কিবলা করে প্রার্থনা করে তাদের কর থেকে অব্যহতি দিও।’ এরপর লোকজন পাইকারি হারে মুসলমান হওয়া শুরু করলো। এই অবস্থা থেকে যারা অন্তরে ইমান নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করছে তাদের পরীক্ষা করার জন্য খৎনার ব্যবস্থা করবেন বলে ভাবলেন সেনাপতি। তিনি এ ব্যাপারে খলিফার সঙ্গে আলাপ করলে খলিফা জবাব দিলেন: আল্লাহ মোহাম্মদকে পাঠিয়েছেন মানুষকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসার জন্য, তাদের খৎনা করানোর জন্য নয়।’ (আল তাবারি ১৯৯২, ৩:৫৯২)
আহমেদ আমিন জানিয়েছেন যে সুদানের এক উপজাতি ইসলাম গ্রহণে ইচ্ছুক হয়। তাদের প্রধান মিশরের আল আজহারে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন, এর জন্য তাদের কী করণীয়। আল আজহার থেকে করণীয় তালিকা পাঠানো হয় যেখানে খৎনার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এরপর ওই উপজাতি মুসলিম হওয়ার সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করে। (আমিন ১৯৯২:১৮৭)
উপরোক্ত বর্ণনাগুলোর জন্য রোজাইয়া মুস্তাফা আবুশারাফ সম্পাদিত Female Circumcision: Multicultural Perspectives বইটি দেখা যেতে পারে। (বিশেষ করে বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়)
অনেক আধুনিক ইসলামি চিন্তাবিদও যথেষ্ট প্রমাণ ও কোরআনের সমর্থনের অভাবে খৎনাকে অপরিহার্য আচার বলে মনে করেন না। তারপরও শুধু পুরুষদের ক্ষেত্রে নয় অনেক মুসলিম দেশে নারীদেরও খৎনার আয়োজন করা হয়।
প্রসঙ্গত কোরআনের একটি আয়াত স্মরণ করা যেতে পারে-
৪:১১৯ আমি (শয়তান) তাহাদেরকে পথভ্রষ্ট করিবই; তাহাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করিবই, আমি তাহাদেরকে নিশ্চয়ই নির্দেশ দিব আর তাহারা পশুর কর্ণচ্ছেদ করিবেই এবং তাহাদেরকে নিশ্চয়ই নির্দেশ দিব আর তাঁহারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করিবেই।…
ভালো-মন্দ অনেক কিছুই মানুষ আল্লাহর নামে উদ্ভাবন করে যার সঙ্গে আল্লাহর কোন সম্পর্ক নেই। (৫:১০৩, ৫৭:২৭)