ভাষার পবিত্রতা

বিশেষভাবে পবিত্র বলে কোন ভাষা নেই। সব ভাষাই নিজ নিজ ভাষাভাষীর কাছে পবিত্র। সাধারণভাবে মুসলিমদের মধ্যে একটা ধারণা প্রচলিত যে আরবী অন্য ভাষার তুলনায় পবিত্র, শ্রেষ্ঠ ভাষা। এই ধারণার কোন ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। অন্তত কোরআনে এরকম কোন ইঙ্গিতও নেই।

আল্লাহ কোন বিশেষ ভাষায় সীমাবদ্ধ নন। সকলের যিনি স্রষ্টা তিনি কেবল একটি ভাষাই বুঝবেন তা নিশ্চয়ই নয়। সকল ভাষাই তার, তিনি সব ভাষাই বোঝেন। তার কাছে যাবতীয় আনন্দ-বেদনা, আবেদন-নিবেদন পেৌছানোর সহজ উপায় তো যার যার মাতৃভাষা।

৩০:২২ আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।

পৃথিবীর সকল নবীকে যে তাদের নিজের ভাষাতেই ওহী দেওয়া হয়েছে সেকথাও পরিস্কারভাবে উলে্লখ করা আছে কোরআনে।

১৪:৪ আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সত্পথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে (২৬:১০৬-১০৭, ২৬: ১২৫-১২৬, ২৬: ১৪৩-১৪৪, ২৬:১৬২-১৬৩, ২৬:১৭৮-১৭৯ ইত্যাদি) পূর্বেকার নবীদের জবানীতে অনেক কথা বলা হয়েছে। তারা সবাই নিশ্চয়ই সেকথাগুলো আরবী ভাষায় বলেননি, নিজ মাতৃভাষাতেই বলেছেন। কোরআনে সেগুলি আরবীতেই (অনুবাদ করে) উলে্লখ করেছেন আল্লাহ। এক অর্থ কোরআন শরীফের একটা উলে্লখযোগ্য অংশই তাই অনুবাদ।

কোরআনও আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে, কারণ এর প্রাথমিক শ্রোতা বা প্রাইমারি অডিয়েন্স ছিল আরবী ভাষাভাষী মানুষ।

১৯:৯৭ আমি তো তোমার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে তুমি উহা দ্বারা মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পার এবং বিতন্ডাপ্রবণ সম্প্রদায়কে এর দ্বারা সতর্ক করতে পার।

যাদের কাছে নাজিল করা হচ্ছে তারা যেন পরিস্কারভাবে তা বোঝে আরবী ভাষায় নাজিলের এটাই উদ্দেশ্য, কথাও কোরআনে একাধিকবার বলা হয়েছে।

১২:২ ইহা আমিই অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় কোরআন, যাতে তোমরা বুঝতে পার।

যে ভাষা কেউ বোঝে না সে ভাষায় বার্তা পাঠানোর এবং পাঠের কোন মানে হয়না। বিষয়টির পরিস্কার উলে্লখ আছে নিচের আয়াতে –

৪১:৪৪ আমি যদি আজমী ভাষায় কোরআন কোরআন অবতীর্ণ করতাম তবে ওরা অবশ্যই বলত, Èএর আয়াতগুলি বিশদভাবে বিবৃত হয় নাই কেন?’ Èকী আশ্চর্য যে , এর ভাষা আজমী অথচ রাসুল আরবীয়।’ বল, মুমিনদের জন্য ইহা পথনির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কোরআনে তাদের জন্য অন্ধত্ব। এরা এমন যে এদের আহ্বান করা হয় যেন বহু দূর হতে।

কোরআনের কোথাও ভাষা হিসেবে আরবী শ্রেষ্ঠ বা এটি জান্নাতের ভাষা তাই এ ভাষাতে কোরআন নাজিল হয়েছে- এমন কোন কথা নেই।

চিরকালের বাণী হলেও প্রাইমারি অডিয়েন্স বা প্রাথমিক শ্রোতা আরবরা বিধায় কোরআন আরবী ভাষাতেই নাজিল হয়। অনেকে নিচের আয়াতটি দিয়ে বোঝাতে চান যে কোরআনের প্রাইমারি অডিয়েন্স আসলে সমগ্র মানবজাতি।

৪২:৭ এইভাবে আমি তোমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় যাতে তুমি সতর্ক করতে পার মক্কা ও তার চারপাশের (হাওলাহা) জনগণকে এবং সতর্ক করতে পার কিয়ামত দিবস সম্পর্কে, যাতে কোন সন্দেহ নাই। সেদিন একদল জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং একদল জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

উপরের আয়াতে হাওলাহা শব্দটি দিয়ে পাশ্ববর্তী অঞ্চলের কথা বোঝানো হয়েছে। সারা পৃথিবীর কথা বলা হয়নি।

হাওলাহু শব্দের অন্য একটি ব্যবহার দিয়ে এটা বোঝা যাবে।

২:১৭ তাদের উপমা: যেমন এক ব্যক্তি অগ্নি প্রজ্জলিত করল, উহা যখন তার চারদিক (হাওলাহু) আলোকিত করল, আল্লাহ তখন তাদের জ্যোতি অপসারিত করলেন এবং তাদের ঘোর অন্ধকারে ফেলে দিলেন, তাহারা কিছুই দেখতে পায় না-

আরবী ভাষাভাষীর বাইরে যারা আছেন তাদের কাছে কোরআন পরিস্কার করে তুলে ধরার মানেই হচ্ছে সেটি প্রাঞ্জলভাবে অনুবাদ করে পেৌছে দেওয়া যেন তারা বুঝতে পারে। একজন চীনাভাষীর কাছে বার্তাটি পেৌছাতে হলে তা নিশ্চিতভাবেই চীনাভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে করতে হবে। গ্রিকের কাছে বললে গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করে বোঝাতে হবে। বাঙালির কাছে বাঙলায়।

সব ভাষাই আল্লাহর। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাভাষী মুসলিমরা আরবীতেই কোরআন পাঠ অনিবার্য মনে করেন। না বুঝে কোরআন পাঠের ফলে বিস্তর বিভ্রানি্ত বয়ে বেড়াতে হয়, যার ফল খুব সুখকর নয়।

কোন ভাষাই পূজা করার বিষয় নয়, বার্তা পেৌছানোর মাধ্যম মাত্র। ধর্মগ্রন্থের কাজ মানবজাতির জন্য পথনির্দেশ করা। মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী তা অনুসরণ করবে এটাই কাম্য।

সূত্র : https://www.quransmessage.com/articles/is%20arabic%20a%20holy%20language%20FM3.htm

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top