বিয়ের বয়স

বিয়ের বয়স বিশ্বের একেক দেশে একেক রকম। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধিকাংশ দেশেই সরকার অনুমোদিত বিয়ের বয়স ১৫ বছর থেকে ২১ বছরে সীমাবদ্ধ। লক্ষণীয় অধিকাংশ দেশই শারীরিক বয়সকেই বিবাহের যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করে।

বিয়ের বয়স সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উল্লেখ না থাকলেও এ ব্যাপারে চমত্কার দিকনির্দেশনা রয়েছে কোরআনে। এই নির্দেশনার কোথাও শিশু বা বালিকা বিবাহের অনুমোদন নেই। এবং শুধুমাত্র শারীরিক যোগ্যতা নয়, মানসিক পরিপক্কতার উপরও যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বিয়ের যোগ্যতা হিসেবে। প্রসঙ্গটির অবতারণা হয়েছে এতিমদের প্রসঙ্গে।

৪:৬ ইয়াতিমদের যাচাই করিবে যে পর্যন্ত না তাহারা বিবাহযোগ্যা (আরবী বালাগুল নিকাহা) হয় এবং তাহাদের মধ্যে ভাল-মন্দ বিচারের জ্ঞান (আরবী রুশদান) দেখিলে তাহাদের সম্পদ তাহাদের ফিরাইয়া দিবে। তাহারা বড় হইয়া যাইবে বলিয়া অপচয় করিয়া তাড়াতাড়ি খাইয়া ফেলিও না। যে অভাবমুক্ত সে যেন নিবৃত্ত থাকে এবং যে বিত্তহীন সে যেন সংগত পরিমানে ভোগ করে। তোমরা যখন তাহাদেরকে তাহাদের সম্পদ সমর্পণ করিবে তখন সাক্ষী রাখিও। হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট।

শিশুদের বিয়ের কোন কথা এ আয়াতে বলা হয়নি, বরং বিবাহের বয়সে পৌছার একটা সীমারেখা উল্লেখ করা হয়েছে যার সঙ্গে পরিস্কার বিষয়বুদ্ধি বিচারবিবেচনাবোধ, পরিপক্কতার বিষয়টিকে জরুরী হিসেবে যোগ করা হয়েছে। অর্থাত্ যে বয়সে কেউ তার নিজের সম্পদ ও সম্পত্তি দেখভালের মতো বুদ্ধিসম্পন্ন হবে সেটিকেই বিয়ের বয়স হিসেবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এই পরিপক্কতা কারো ১৬ বছরে হতে পারে কারো ১৮ বছরে হতে পারে কারো ২০ বছরেও হতে পারে। আয়াতে সাক্ষীর উল্লেখ উভয় পক্ষের দায়িত্ব ও চুক্তি সম্পাদনের প্রকৃতির দিকেও ইঙ্গিত প্রদান করে। উল্লেখ্য বিবাহ একটি সামাজিক চুক্তিও বটে। এই চুক্তি সম্পাদনের সক্ষমতা কোন অবুঝ ৬ বা ৯ বছরের পুতুলখেলার শিশুর থাকার কথা নয়। বিবাহযোগ্য বয়স এবং এতিমদের সম্পত্তি প্রত্যার্পনের বিষয়টি একসূত্রে গাঁথা হয়েছে এ আয়াতে।

অন্যদিকে ৬:১৫২ আয়াতে বিশ্বাসীদের বলা হয়েছে যেন এতিমদের সম্পত্তির কাছে না আসে যতক্ষণ না তারা ‘আশুদ্দ’ হয়; অর্থাত্ তারা শারীরিকভাবে পূর্ণতালাভ করে বা সোজাকথায় প্রাপ্তবয়স্ক হয়।

৬:১৫২ ইয়াতিম বয়ঃপ্রাপ্ত (আশুদ্দাহু) না হওয়া পর্যন্ত উত্তম ব্যবস্থা ব্যতীত তোমরা তাহার সম্পত্তির নিকটবর্তী হইবে না এবং পরিমান ও ওজন ন্যায্যভাবে পুরোপুরি দিবে।….

আরবী শব্দ আশুদ্দ মূলত শারীরিক পূর্ণতা বা পরিপূর্ণ শক্তিমত্তার কথাই নির্দেশ করে। যেমন ১২:১৯ আয়াতে ইউসুফ (সাঃ) কে সাধারণ বালক/কিশোর (আরবী গুলামুন) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পরে (১২:২২-২৩ আয়াতে) যখন সে পূর্ণ যৌবনে পৌছে গেছে সে বয়সটিকে নির্দেশ করতে ব্যবহার করা হয়েছে আশুদ্দ শব্দটি। এছাড়াও ১৮:৮২ আয়াতেও দুটি বালকের বয়োপ্রাপ্ত হওয়া প্রসঙ্গেও গুলামায়িনি ও আশুদ্দ শব্দের ব্যবহার লক্ষনীয়। ৪৬:১৫ আয়াতেও পরিপক্ক বয়স প্রসঙ্গেও আশুদ্দ ব্যবহূত হয়েছে।

১২:১৯ এক যাত্রীদল আসিল, উহারা উহাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করিল। সে তাহার পানির ডোল নামাইয়া দিল। সে বলিয়া উঠিল, কী সুখবর! এ যে এক কিশোর! (গুলামুন)

১২:২২-২৩ যে যখন পূর্ণ যৌবনে (আশুদ্দাহু) উপনীত হইল তখন তাহাকে আমি হিকমত ও জ্ঞান দান করিলাম। এবং এইভাবেই আমি সত্কর্মপরায়নদেরকে পুরস্কৃত করি।

১৮:৮২ আর ঐ প্রাচীরটি, ইহা ছিল নগরবাসী দুই পিতৃহীন কিশোরের (গুলামায়িনি) গুপ্তধন, ইহার নিম্নদেশে আছে উহাদের গুপ্তধন এবং উহাদের পিতা ছিল সত্কর্মপরায়ন। সুতরাং আপনার প্রতিপালক দযাপরবশ হইয়া ইচ্ছা কলেন যেম উহারা বয়ঃপ্রাপ্ত হউক (আশুদ্দাহুমা) এবং উহারা উহাদের ধনভান্ডার উদ্ধার করুক। …

ফলে, বোঝাই যাচ্ছে, শারীরিক ও মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপক্কতাই একজনকে বিবাহের উপযুক্ত সময়।
এমনকি ১৮ বছরে কারো শারীরিক সক্ষমতা হলেও মানসিক বিকাশ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রেও সে বিবাহ প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত হবে না। ফলে সুনিদ্দিষ্ট বয়সের উল্লেখ না করাটাই উত্তম। পুরুষের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যোগ্যতা হলো, স্ত্রীর ভরণপোষণ দেখভালের যোগ্যতা তার থাকতে হবে। (৪:৩৪ ইত্যাদি )

প্রসঙ্গত আনুষ্ঠানিক চুক্তির কিংবা সুদৃঢ় অঙ্গীকারের (মিছাক্বান গালিজান) বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে। কোরআনের আয়াত থেকে এটা পরিস্কার যে. বিবাহ একটি দৃঢ় সামাজিক চুক্তি/অঙ্গীকার যেখানে উভয় পক্ষের সম্মতি আবশ্যক। বলাবাহুল্য চুক্তি সর্বদাই দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। একারণেই সাক্ষীও জরুরী। বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও তাই।

আগের স্ত্রীকে দেয়া সম্পদ ফিরিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে বিয়ের চুক্তিকে দৃঢ় অঙ্গীকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

৪:২১ আর কিরুপে তোমরা উহা গ্রহণ করিবে, যখন তোমরা একে অপরের সঙ্গে সংগত হইয়াছ এবং তাহারা তোমাদের নিকট হইতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি (মিছাকান গালিজান) লইয়াছ?

কোরআনে অন্যত্র এই মিছাক্বান গালিজান শব্দযুগল কীভাবে ব্যবহূত হয়েছে তা দেখা যাক। তা থেকেই বিবাহ কী ধরনের চুক্তি এবং এর সত্যিকার গুরুত্ব কতটুকু সেটা উপলদ্ধি করা যাবে।

ক. সাবাথ বা বিশ্রাম দিবস প্রসঙ্গে ইসরায়েলের বংশধরদের কাছে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন আল্লাহ।

৪:১৫৪ তাহাদের অঙ্গীকারের জন্য তুর পর্বতকে আমি তাহাদের উর্ধে উত্তোলন করিয়াছিলাম এবং তাহাদেরকে বলিয়াছিলাম, নতশিরে দ্বার দিয়া প্রবেশ কর। তাহাদেরকে আরও বলিয়াছিলাম শনিবার সম্পর্কে সীমা লংঘন করিও না এবং তাহাদের নিকট হইতে দৃঢ় অঙ্গীকার (মিছাকান গালিজান) লইয়াছিলাম।

খ. সব নবীদের কাছ থেকে আল্লাহর অঙ্গীকার গ্রহণ

৩৩:৭ স্মরণ কর যখন আমি নবীদের নিকট হইতে অঙ্গীকার গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং তোমাদের নিকট হইতেও এবং নুহ, ইবরাহিম, মুসা ও মারইয়াম-তনয় ঈসার নিকট হইতেও- তাহাদের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার (মিছাকান গালিজান)।

কোরআনের ভাষ্যে বিবাহের অঙ্গীকারকে চরম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের জন্য এরকম অঙ্গীকারই বিধেয়। বৃদ্ধিবৃত্তিক তথা মানসিক পরিপূর্ণতা ছাড়া এ ধরনের অঙ্গীকারের চরিত্র ও তাত্পর্য বা নিহিতার্থ বোঝা সম্ভব নয়। কোন শিশুর পক্ষে তো নয়ই। প্রসঙ্গত ৪:১২৭ আয়াতের কথাও বলা যায়।

৪:১২৭ আর লোকে তোমার নিকট নারীদের বিষয়ে ফাতওয়া জানিতে চায়। বল, আল্লাহ তোমাদের তাহাদের সম্বন্ধে (ফিহিনা) বিধান জানাইতেছেন এবং ইয়াতীম নারী (ইয়াতামন নিসা) সম্পর্কে যাহাদের প্রাপ্য তোমরা প্রদান কর না, অথচ তোমরা তাহাদের বিবাহ করিতে চাও এবং অসহায় শিশুদের সম্বন্ধে ও ইয়াতিমদের (আরবী ইয়াতামা) প্রতি তোমাদের ন্যায়বিচার সম্পর্কে যাহা কিতাবে তোমাদেরকে শোনান হয় তাহাও পরিস্কারভাবে জানাইয়া দেন। …

এখানে পরিস্কার যে ‘ফিহিনা’ বলতে নারীদের কথাই বোঝানো হচ্ছে। অর্থাত্ যে বিধানের আলাপ হচ্ছে সেটি নারী সংক্রান্ত। ‘ইয়াতামানিসা’ শব্দটিও এই ধারণার সমর্থন যোগায় যার অর্থ ইয়াতিম নারী। এখানে এটা পরিস্কার যে কেবলমাত্র নারীরাই বিবাহযোগ্যা, বালিকারা নয়। বাল্যবিবাহের সমাধি এ আয়াতেই নিশ্চিত করা আছে।

সূত্র : http://quransmessage.com/articles/ayesha%20age%20FM3.htm
(আয়াতের অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আল কুরআনুল করীম থেকে নেওয়া)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top