বিবর্তনবাদ ও কোরআন

বিবর্তনবাদ বা এর বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা বর্তমান আলোচনার লক্ষ্য নয়। এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়েছে, সেসব থেকে আগ্রহী পাঠক দরকারী তথ্য পেয়ে যাবেন। বর্তমান আলোচনার লক্ষ্য দ্বিবিধ:

১. বিবর্তনবাদ তত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা এবং
২. কোরআনে এ তত্ত্বের পক্ষে কোন সমর্থন আছে কিনা তা যাচাই করা।

প্রথমত, বিবর্তনবাদ কিন্তু স্রষ্টার অস্তিত্ব কিংবা জীবন সৃষ্টির সূচনা নিয়ে কোনরকম আলোচনা করে না। এর মূল কথা হচ্ছে অতীতের বিভিন্ন রকম জীব সময়ের পরিক্রমায় বিবর্তিত হয়ে উন্নততর ও জটিল জীবে রুপান্তরিত হয়েছে।

নাস্তিকদের পাশাপাশি অনেক আস্তিকও এই ধারণাকে সমর্থন করেন। সাধারণ বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় এই তত্ত্বকে তথ্য হিসেবেই কবুল করেন। বিবর্তন প্রক্রিয়ার সমর্থক আস্তিকদের ভাবনায় কিছু সুক্ষ পার্থক্য রয়েছে এবং তারা প্রবলভাবেই বিশ্বাস করেন যে এই বিবর্তনের প্রক্রিয়া স্রষ্টার নির্দেশনাতেই হয়েছে। তাদের এই ভাবনার ভিত্তি ধর্মগ্রন্থের কিছু বিবরণ এবং তার ব্যাখ্যা।

বিবর্তনবাদ তত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

‘অতঃপর সৃষ্টি জগতের দিকে লক্ষ করুন, কীভাবে খনিজ পদার্থ থেকে আরম্ভ করে এক অপূর্ব ধারাবাহিকতায় উদ্ভিদ ও প্রাণী পর্যন্ত সুবিন্যস্ত রয়েছে। খনিজ পদার্থের শেষ দিক (২৬৯) উদ্ভিদের প্রথম দিকের সাথে সংযুক্ত, যেমন ঔষধি ও বীজহীন গুল্ম; উদ্ভিদের শেষ দিক, যেমন খেজুর ও আঙুর লতা; প্রাণীর প্রথম দিকের সাথে সংযুক্ত, যেমন শামুক ও ঝিনুক- এদের কেবল স্পর্শশক্তিই বিদ্যমান। এ সৃষ্টি জগতের পরস্পর সংযুক্তির অর্থ হল তাদের যে কোন একটির শেষ দিক পরবর্তীটির প্রথম দিকে পরিবর্তিত হবার জন্য অদ্ভুতভাবে উন্মুখ হয়ে রয়েছে। অতঃপর, প্রাণীজগত বিস্তৃতিলাভ করে বহু শাখায় বিভক্ত হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমিক সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে মনন ও দর্শনের অধিকারী মানুষে এসে উপনীত হয়েছে। মানুষের এই পর্যায় বানর জগত থেকে উন্নীত হয়েছে, যে জগতে অনুভূতি ও উপলদ্ধি একত্র হয়েছিল কিন্তু বাস্তব, মনন ও দর্শনে পৌছতে পারেনি। এর পর মানুষের প্রথম দিকের আরম্ভ এবং এটাই আমাদের অভিজ্ঞতার শেষ পর্যায়।’

উপরের উদ্ধৃতাংশ পড়ে যে কারো ধারণা হতে পারে এটি ডারউইনের (মৃত ১৮৮২) লেখা ‘অন দি অরিজিন অফ স্পিশিজ’ (প্রকাশিত ১৮৫৯) থেকে নেওয়া। তবে পাঠক বিষ্মিত হবেন জেনে যে আদতে উল্লিখিত অংশটুকু ডারউইনের প্রায় ৫০০ বছর আগের মুসলিম ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ইবনে খালদুনের (জন্ম ১৩৩২, মৃত্যু ১৪০৬ সালে) বিখ্যাত মুকাদ্দিমা গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত। (দেখুন গোলাম সামদানী কোরায়শী অনূদিত আল মুকাদ্দিমা ১ম খণ্ড, দিব্যপ্রকাশ, পৃষ্ঠা ১৯৩)।

প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের শুরুর দিক থেকেই মুসলিম দার্শনিকরা বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিভিন্ন ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে পড়ানোও হয়েছে।

উনিশ শতকের বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রসায়নবিদ, ঐতিহাসিক, আলোকচিত্রী, চিকিত্সক ও চার্লস ডারউইনের (১৮০৯-১৮৮২) সমসাময়িক জন উইলিয়াম ড্রেপার (১৮১১-১৮৮২) বিবর্তনবাদ নিয়ে মুসলিম দার্শনিকদের ভাবনার কথা জানতেন। ১৮৭৮ সালে ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ড্রেপারের হিস্টরি অফ দি কনফ্লিক্ট বিট্যুইন রিলিজিয়ন অ্যান্ড সায়েন্স গ্রন্থের কন্ট্রোভার্সি রেসপেক্টিং দি এইজ অফ দি আর্থ শীর্ষক সপ্তম অধ্যায়ে তিনি বিবর্তনবাদকে প্রকারান্তরে মোহামেডান থিওরির উপর ভিত্তি করে রচিত বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন,

“Theological authorities were therefore constrained to look with disfavour on any attempt to carry back the origin of the earth, to an epoch indefinitely remote, and on the Mohammedan theory of the evolution of man from lower forms, or his gradual development to his present condition in the long lapse of time”.

ইসলামের প্রথম দিকে, যাকে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলেও অভিহিত করা হয় (অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতক), সেসময়ের ইসলামি দর্শন নিবিড়ভাবে পাঠ করলে প্রচুর নমুনা মেলে যা আস্তিক বিবর্তনবাদকে সমর্থন করে।

এ প্রসঙ্গে ড. আহমেদ আফজালের ‘ব্রিজিং দি গালফ- কোরআন অ্যান্ড হিউম্যান ইভুল্যুশন’ রচনাটির কথা উল্লেখ করা যায়। এর দি ডুয়াল ন্যাচার অফ ম্যান (পৃষ্ঠা ৪৫) শীর্ষক প্যারাতে তিনি লিখেছেন-

“The first thing that needs to be noted is that the idea of evolution is not an alien adversary vis-à-vis Islam and Muslims, but that it actually belongs to the forgotten legacy of our own ancestors. It was Allama Iqbal (1877- 1938) who first re-claimed this lost heritage by pointing out that it was actually Muslim scientists and scholars who had presented, for the first time in modern era, the idea of organic evolution, and they did so centuries before Lamarck or Darwin. Iqbal recalled that it was Al Jahiz (776-869 CE), the author of Kitab al-Haiwanat who first put forward the idea of evolution in the animal kingdom, and Ibn Maskawaih (942-1032 CE), the author of Fauz al-Asghar, who wrote about the evolution of man from inanimate matter to plants and then to the animals, and mentioned the close relationship between man and ape. In addition, we find the idea of evolution expressed in various forms by Al-Mas‘udi, Al-Bairuni, Jalaluddin Rumi, and Ibn Khaldun”
(রচনাটি অনলাইনে সহজলভ্য : http://data.quranacademy.com/QA_Publications/ariticles/English/AhmedAfzal/QuranAndHumanEvolution.pdf )

মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে বিবর্তনবাদের সমর্থক সব সময়েই ছিল যারা একে স্রষ্টা নির্দেশিত পন্থা হিসেবেই বিবেচনা করতেন। আধুনিক যুগের ট্রাডিশনাল মুসলিমদের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। (এ প্রসঙ্গে শুনতে পারেন ড. ইসরার আহমেদের (মৃত ২০১০) রাউণ্ড টেবিলের বক্তব্য।
লিঙ্ক : https://www.google.com/search?q=Dr+Israr+Ahmad+round+table+vedio&source=hp&ei=9O3UY-eZF4K84-EP07SL-)

অধিকন্তু, বিবর্তনবাদের ধারণা মুসলিম দার্শনিকদের কাছেও নতুন কিছু নয়, এর আগে গ্রিক দার্শনিকরাও এ বিষয়ে তাদের ভাবনার কথা বলে গেছেন। ড. আহমেদ আফজালের রচনার ৩২ নং পৃষ্ঠাতে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে:

“The idea of gradual and orderly change or evolution can be traced to the beginning of Greek philosophy, when Heraclitus said that everything moves and everything changes. Aristotle not only taught the idea of evolution, but also provided a theory of its causes”.

প্রাণীবিদ্যার প্রাকৃতিক ইতিহাসে তার এ বিষয়ক ধারণার কথা ব্যক্ত করেছেন এরিস্টটল।

Aristotle and the Arabs: The Aristotelian Tradition in Islam শীর্ষক গ্রন্থের হিস্টরি অফ অ্যানিম্যালস (ল্যাটিন: হিস্টরিয়া অ্যানিম্যালিয়াম) এ এফ ই পিটার্স লিখেছেন:

“In the 11th century, al-Khatib al-Baghdadi accused al-Jahiz of having plagiarized parts of his work from the Kitāb al-Hayawān of Aristotle, (15) but modern scholars have noted that there was only a limited Aristotelian influence in al-Jahiz’s work, and that al-Baghdadi may have been unacquainted with Aristotle’s work on the subject. (16) In particular, there is no Aristotelian precedent for al-Jahiz’s ideas on topics such as natural selection, environmental determinism and food chains” .

সুতরাং বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে ডারউইনিজমের সমার্থক নয় বা একে সেভাবে দেখা উচিতও নয়। বিবর্তনবাদ ডারউইনের তত্ত্ব থিওরি নয়। অথবা তার ব্যাখ্যাও বিজ্ঞানীমহলে সর্বজনগ্রাহ্যও হয়নি। ফসিলের নমুনা বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে আরো ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করছে। যেমন ১৯৭২ সালে দুই প্রত্নতত্ত্ববিদ স্টিফেন গৌল্ড এবং নিলস এলড্রেজ বিরামচিহ্নিত ভারসাম্য (punctuated equilibrium) তত্ত্ব উপস্থাপন করেন যেখানে বিভিন্ন জীবাশ্ম রেকর্ডের অসঙ্গতি তুলে ধরা হয় যা বিবর্তনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে তুলে ধরে না এবং ডারউইনের তত্ত্বকে সমর্থন করে না। বরং এ তত্ত্ব বলে যে, বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে পরিবর্তন বহু দীর্ঘ স্থবির সময়ের ব্যবধানে ঘটে থাকে।

মোটকথা বিবর্তনের আলোচনায় ডারউইনই প্রথম বা শেষ ব্যক্তি নন।

কোরআনে বিবর্তনের পক্ষে সমর্থন আছে কি?
বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করলে আর ঈমান থাকবে না এরকম একটা ধারণা অনেক ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই আছে। আর বিবর্তনের কথা শুনলেই এদের সকলের মনে প্রথমেই ভেসে ওঠে বানর থেকে মানুষ হওয়ার বিষয়টা। বিবর্তনবাদ বানর থেকে মানুষ হওয়ার কথা বলে না। বরং তার বক্তব্য হলো এটাই যে, বানর ও মানুষ অর্থাত্ প্রাইমেট বা স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর পূর্বপুরুষ একই। বানর থেকে মানুষ হওয়ার থেকে এটি ভিন্ন প্রস্তাব।

কোরআনে বারংবার এবং পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে আকাশ ও পৃথিবী তৈরি হয়েছে ৬ আইয়্যামে বা পর্যায়ে বা যাকে আমরা দিবস বলে অনুবাদ করে থাকি। (৭:৫৪; ১০:৩; ১১:৭; ২৫:৫৯; ৩২:৪; ৫০:৩৮; ৫৭:৪)

আল্লাহর নির্দেশ (হও এবং তা হয়ে যায়- আরবী কুন ফায়্যাকুন)- এটাকে বিশ্বসৃষ্টির ক্ষেত্রেও তাত্ক্ষণিক বিবেচনা করা জরুরী নয়। এটা একটা নির্দেশ যা একটি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার প্রারম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা যায় যা সম্পন্ন হতে যুগ যুগও লেগে যেতে পারে। আকাশ ও পৃথিবীর সৃজনের প্রক্রিয়া থেকেও এটা পরিষ্কার বোঝা যায়।

২:১১৭ আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা এবং যখন তিনি কোন কিছু করিতে সিদ্ধান্ত করে তখন উহার জন্য শুধু বলেন হও, আর উহা হইয়া যায় (আরবী কুন ফায়্যাকুন)।

উপরন্তু, মানুষের সময় ধারনা দ্বারা আল্লাহ সীমাবদ্ধ নন। তিনি সময়ের স্রষ্টা। তার কাছে সময়ের মানে ভিন্ন। তার এক দিন আমাদের হাজার দিনের সময় হতে পারে।

২২:৪৭ তাহারা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করিতে বলে, অথচ আল্লাহ তাঁহার প্রতিশ্রুতি কখনও ভঙ্গ করেন না। তোমার প্রতিপালকের নিকট একদিন তোমাদের গণনার সহস্র বত্সরের সমান।

৩২:৫ তিনি আকাশ হইতে পৃথিবী পর্যন্ত সমুদয় বিষয় পরিচালনা করেন, অতঃপর এক দিন সমস্ত কিছু তাঁহার সমীপে সমুত্থিত হইবে- যে দিনের পরিমাপ হইবে তোমাদের হিসাবে সহস্র বত্সর।

৭০:৪ ফিরিশতা এবং রূহ আল্লাহর দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন এক দিনে যাহার পরিমাণ পার্থিব পঞ্চাশ হাজার বত্সর।

পৃথিবীর সব কিছু তৈরি হয়েছে ৪ পর্যায়ে
মোট ৬ পর্যায়ের বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে পৃথিবীর অভ্যন্তরীন বিষয়াদি তৈরি হতে লেগেছিল ৪টি পর্যায়কাল। এ দ্বারা এটা পরিস্কার যে বিষয়টা মুহূর্তে বা তাত্ক্ষণিকভাবে হয়নি।

৪১:১০ তিনি স্থাপন করিয়াছেন অটল পর্বতমালা ভূপৃষ্ঠে এবং উহাতে রাখিয়াছেন কল্যান এবং চারিদিনের মধ্যে ইহাতে ব্যবস্থা করিয়াছেন খাদ্যের সমভাবে যাচনাকারীদের জন্য।

এখানে স্মরণ রাখা জরুরী, এখানে খাদ্য বা ভরণপোষণ বলতে কেবল মানুষ নয়, এই গ্রহের সকল ধরণের প্রাণীর কথা, বিশেষ করে খাদ্যশৃঙ্খলের বিষয়টিও মাথায় রাখা জরুরী। প্রাণীরাজ্যের এই খাদ্যচক্রে অনেক খাদক নিজেও খাদ্যে পরিণত হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে ৪ পর্যায়ে।

[আলাদা আলাদাভাবে লক্ষ করুন ৪১:১২-১৭, ৪১:১০, ৪১:১১, ৬৫:১২, ৪১:৯, ৪১:১০। ৪১:১২-১৭ আয়াতে আকাশ সৃষ্টি, প্রতিটি বিধান তৈরি, নিম্নতম আকাশে আলোকোজ্জল করা। এটা আমাদের গ্যালাক্সিকে নির্দেশ করা হতে পারে যেখানে অনেক তারকা বিশেষ করে আমাদের সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র রয়েছে।
৪১:১০ পৃথিবীর পাহাড় গঠন, জীবন্ত সত্তাগুলোর জন্য ভরণপোষণের ব্যবস্থা, পৃথিবীকে বিস্তৃত করা (৭৯:৩০)। ৪১:১১ আকাশ ও পৃথিবীকে গঠনের নির্দেশ। পৃথিবীর পাশাপাশি অনেক মহাজাগতিক বস্তুও তৈরি হয়েছে (৬৫:১২)।

৪১:৯ মোট দুই পর্যায়। ৪১:১০ মোট ৪ পর্যায়। সব মিলিয়ে ৬ পর্যায় (৩২:৪, ৫০:৩৮, ১০:৩, ১১:৭, ৭:৫৪)।]

খাবার চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে টেবিলে তৈরি হয়ে আসে, ব্যাপারটা তা নয়। এর জন্য বীজ বপন, শষ্য ফলানো, আহরণ, রান্না করে তারপর প্লেটে উপস্থাপন করা হয়। মানুষও শিশু থেকে কিশোর, তরুন, যুবক হয়ে বৃদ্ধ হয়। সর্বত্রই এভাবে বিবর্তনের খেলা বিদ্যমান।

বাশার ও ইনসানের পার্থক্য
বর্তমান নিবন্ধের খাতিরে উপরোক্ত টার্ম দুটির পার্থক্য বোঝাটা জরুরী। কোরআন শরিফে মানুষকে বোঝাতে আলাদা দুটি টার্ম ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণত এ দুটি শব্দকে সমার্থক বিবেচনা করা হয়।

বাশার
বা-শিন-রা শব্দমূলে তৈরি শব্দটি মূলত মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্যকেই নির্দেশ করে। মানুষের ত্বক, তার সৌন্দর্য, সুন্দর গঠন, শারীরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, ত্বকের স্পর্শ ইতাদির ক্ষেত্রে শব্দটির প্রয়োগ লক্ষণীয়। এটা আনন্দ ও সুসংবাদের মতো অর্থেও ব্যবহূত হয়।

ইনসান
ইনস (আলিফ-নুন-সিন) শব্দমূলে তৈরি ইনসান মূলত মানুষের বিভিন্ন দক্ষতা, উপলদ্ধি ও জ্ঞানকে নির্দেশ করে। ইনসান বন্ধুভাবাপন্ন কিংবা মানুষের সাথে মিশতে চায়, কথা বলতে চায়, আলোচনা করতে চায়। সে সামাজিক, আলাপী, বিনয়ী, প্রফুল্ল।

উদাহরণস্বরুপ ২৮:২৯ আয়াতে লক্ষ্য করি নবী মুসা (সাঃ) অনুমান/ধারণা/উপলদ্ধি করলেন (আরবী আনাসা) দুরে আগুন রয়েছে। এখানে আরবী শব্দ আনাসার শব্দমূল একই ইনস। ৪:৬ আয়াতেও ইয়াতিমদের ভালো মন্দের জ্ঞান যাচাই করার কথাপ্রসঙ্গে বলা হয়েছে তাদের মধ্যে এই পরিপক্কতা অনুমান/উপলদ্ধি করতে পারলে (আরবী আনাসতুম) তখন তাদের সম্পদ তাদের কাছে সমর্পণ করতে হবে। এখানেও একই শব্দমূল ইনস।
এখানে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, বাশার ও ইনসানের মধ্যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে। দুটি শব্দ মানুষের দুটি দিক নির্দেশ করে।

কোরআন পাঠের সময় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে শব্দ দুটির ব্যবহার আলাদাভাবে লক্ষণীয়।

মানবসৃষ্টির মধ্যে সময়ের ব্যবধান

১৫:২৬ আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছি গন্ধযুক্ত কর্দমের (আরবী হামিন) শুষ্ক ঠনঠনা (আরবী মাসনুন) মৃত্তিকা (আরবী সালসালিন) হইতে।

লক্ষ্য করুন ঠনঠনা (কিংবা প্রকৃত অর্থে পরিবর্তিত) বোঝাতে আরবী মাসনুন ব্যবহার করা হয়েছে। মানসুনেরও শব্দমূল একই (সিন-নূন-নূন) যা দিয়ে সুন্নাহ এর মতো অন্য অনেক শব্দ তৈরি হয়। এই শব্দমূলের অর্থ একটি পথ অনুসরণ করা, আচরণবিধি, জীবনপ্রণালী, আইন প্রতিষ্ঠা করা, কোন কিছু গঠন করা, ছাঁচে ফেলা, পোলিশ করা। সুতরাং একটি ধারাবাহিক পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত এই শব্দটির মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে।

পরের দুটি আয়াতেও নশ্বর মানবদেহ এবং তার মধ্যে আল্লাহর রুহ ফুত্কার করে দেওয়ার মধ্যকার সময় ব্যবধানের বিষয়টি এসেছে।

১৫:২৮-২৯ স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাগণকে বলিলেন, আমি গন্ধযুক্ত কর্দমের শুষ্ক ঠনঠনা মৃত্তিকা হইতে মানুষ (আরবী বাশারান) সৃষ্টি করিতেছি; যখন আমি উহাকে সুঠাম করিব (বা গঠন সম্পূর্ণ করিব) এবং উহাতে আমার পক্ষ হইতে রুহ সঞ্চার করিব তখন তোমরা উহার প্রতি সিজদাবনত হইও।

উপরের আয়াত থেকে সহজেই বোঝা যায়, মানুষের দেহে যখন আল্লাহর রুহ ফুত্কার করে দেওয়া হয়েছে তখনই সে পূর্ণ মানবে পরিণত হয়েছে। এটাই ইনসান হিসেবে আদমকে তার পূর্ববর্তী বাশার কিংবা বাশারের মতো কোন শারীরবৃত্তীয় অবস্থা থেকে তাকে পৃথক করেছে।

মানুষকে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে।

৭১:১৪ অথচ তিনিই তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন পর্যায়ক্রমে

উপরের আয়াতে মানুষের মাতৃগর্ভে থাকাকালীন পর্যায়ের কথাও বলা হতে পারে আবার দীর্ঘকালব্যাপী বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ তৈরির পর্যায়ের কথাও হতে পারে। তবে ঠিক পরের আয়াতটিকে বিবেচনায় নিলে দীর্ঘকালীন বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ তৈরির বিষয়টিকেই অগ্রগণ্য মনে হয়। আয়াতটিতে আকাশ তৈরির যে উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া।

৭১:১৫ তোমরা কি লক্ষ্য কর নাই আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন সপ্তস্তরে আকাশমণ্ডলী?

স্তরে স্তরে আকাশ তৈরির তুলনাটি উপেক্ষা করা যায় না। অন্যত্র যেখানে ৬টি পর্যায়ের এর সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।
এর কয়েক আয়াত পরেই বলা হয়েছে:

৭১:১৭ তিনি তোমাদিগকে উদ্ভুত করিয়াছেন মৃত্তিকা হইতে (আরবী আনবাতাকুম)

আরবীতে আনবাতাকুম শব্দটি তৈরি হয়েছে নূন-বা-তা শব্দমূলে যার অর্থ বড় হওয়া, অঙ্কুরিত হওয়া, গাছের মতো বেড়ে ওঠা বা শিশুর মতো বেড়ে ওঠা।

২৬:৭ উহার কি যমীনের দিকে লক্ষ্য করে না? আমি উহাতে প্রত্যেক প্রকারের কত উত্কৃষ্ট উদ্ভিদ উদগত (আরবী আনবাতনা) করিয়াছি!

কোরআনে মৃত্তিকা থেকে গাছের উদ্ভবের সঙ্গে মানব সৃষ্টির যে সাদৃশ্য রচনা করা হয়েছে তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দুটি ক্ষেত্রেই একই টার্ম ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের রাসুল সালেহ (সাঃ) যখন আল্লাহর বাণী প্রচার করেন তখন সামুদ জনগোষ্ঠীও এই ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল।

১১:৬১ আমি ছামুদ জাতির নিকট তাহাদের ভ্রাতা সালিহকে পাঠাইয়াছিলাম। সে বলিয়াছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নাই। তিনি তোমাদিগকে মৃত্তিকা হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং উহাতেই তিনি তোমাদিগকে বসবাস করাইয়াছেন। সুতরাং তোমরা তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর আর তাঁহার দিকেই প্রত্যাবর্তন কর। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক নিকটে, তিনি আহ্বানে সাড়া দেন।

অন্যত্রও কুমোর যেমন মাটির পাত্র তৈরি করে সেভাবে মানুষ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।

৫৫:১৪ মানুষকে তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন পোড়া মাটির মত শুষ্ক মৃত্তিকা হইতে

৬৪:৩ তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী যথাযথভাবে এবং তোমাদিগকে আকৃতি দান করিয়াছেন – তোমাদের আকৃতি করিয়াছেন সুশোভন, এবং প্রত্যাবর্তন তো তাঁহারই নিকট।

২১:৩০ যাহারা কুফরী করে তাহারা কি ভাবিয়া দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মিশিয়া ছিল ওতপ্রোতভাবে, অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করিয়া দিলাম; এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করিলাম পানি হইতে; তবুও কি উহারা ঈমান আনিবে না?

অনেকে ধারণা করেন, আদমকে বেহেশতে বা জান্নাতে তৈরি করা হয়েছে। পরে তাকে ধূলির ধরায় প্রেরণ করা হয়েছে। আদতে সে জান্নাত (যার অর্থ বাগান) পৃথিবীরই কোন এলাকা। এ বিষয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

এটা উপলদ্ধি করা প্রয়োজন যে মানুষ আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি হয়েছে তার দেহকাঠামোর কারণে নয়। বরং আল্লাহর রুহ যখন তার ভিতরে এসে যুক্তি বুদ্ধি, বিচারবুদ্ধি, ভালোবাসা, ক্ষমা, বিশেষ যোগাযোগের দক্ষতা বা ক্ষমতা ইত্যাদি সঞ্চারিত করল তখনই সে পৃথিবীতে প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য হলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top