ছোটবেলায় লম্বা ছুটিতে যখন দাদাবাড়ি যেতাম তখন অনেক অভিজ্ঞতার মাঝে একটি ছিল ভয়ংকর – বাঁশের পুল পার হওয়া। খালের উপর আড়াআড়িভাবে একটা বাঁশ ফেলে রাখা। তার একপাশে হাত দিয়ে ধরার জন্য রেলিংয়ের মতো একটা বাঁশ কখনো থাকতো কখনো থাকতো না। আমার ছোট হাত ওই রেলিং অব্দি পৌছাতো না। ফলে চাচাদের হাত ধরে কলেমা পড়তে পড়তে কোনরকমে ওই সেতু পার হতে হতো। গ্রামের সমবয়সীরা কত অবলীলায়, কখনো কখনো দৌড়াতে দৌড়াতে ওই ভয়ংকর সেতু পার হয়ে যেতো- দেখে টাশকি খেতাম। ওই বয়সেই বিভিন্ন ওয়াজে পুলসিরাতের খবর শুনে আতংক আরো জমে উঠেছিল। পরে, অনেক পরে বুঝেছি, কেয়ামতের দিনটি ভয়ংকর হলেও, পুলসিরাতের ভয়টা অমূলক।
পুলসিরাত কী? বুখারিসহ অন্যান্য হাদিসের বইতে পুলসিরাত বলতে চুলের চেয়েও সরু এবং তরবারির মতো ধারালো একটি দীর্ঘ সাঁকোর কথা বলা হয়েছে। নানারকম হূক আংটা ও কাঁটাওয়ালা লোহার অবলম্বনে ঝুলে থাকবে এটি। শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সবাইকে এর উপর দিয়ে যেতে হবে। এর নিচে থাকবে দোজখের লেলিহান শিখা। এটি পেরিয়ে গেলেই দেখা মিলবে স্বর্গের দুয়ার। যারা এটি অতিক্রম করতে পারবে না, অনিবার্যভাবে তাদের স্থান হবে নিচের দোযখে। যারা ইমানদার, সত্কর্ম করেছে এটি পেরিয়ে যেতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। সেতুটি প্রথম পার হবেন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। পুলসিরাতের পক্ষে কিছু হাদিস ছাড়াও বিস্তর রচনা, সাহিত্য ওয়াজ ইত্যাদি জারি আছে এখনো। (বুখারি শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দশম খন্ড ৬৯৩১, ৬৯৪২ ইত্যাদি।)
কোরআনের আলোকে উপরের ধারণাগুলো বিবেচনা করে দেখলে কিছু প্রশ্ন জাগে।
১.
কোরআনের বিভিন্ন সুরায় বিচার দিবসের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। যেমন সুরা আরাফ, সুরা ওয়াক্বিয়া, সুরা আর রাহমান ইত্যাদি। কিন্তু কোথাও পুলসিরাতের মতো মেজর ইভেন্টের কোন উল্লেখ নেই।
লক্ষনীয় ২১:৯৮-১০২ আয়াতে বরং বলা হচ্ছে-
তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাহাদের ইবাদত কর সেগুলি তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সকলে উহাতে প্রবেশ করিবে (ওয়ারিদুনা)। যদি উহারা ইলাহ হইত তবে উহারা জাহান্নামে প্রবেশ করিত না (ওয়ারাদুহা); উহাদের সকলেই উহাতে স্থায়ী হইবে।
সেখানে থাকিবে উহাদের আর্তনাদ এবং সেখানে উহারা কিছুই শুনিতে পাইবে না।
যাহাদের জন্য আমার নিকট হইতে পূর্ব হইতে কল্যান নির্ধারিত রহিয়াছে, তাহাদের উহা হইতে দূরে রাখা হইবে। তাহারা উহার ক্ষীণতম শব্দও শুনিবে না এবং সেখানে তাহারা তাহাদের মন যাহা চায় চিরকাল উহা ভোগ করিবে।
ওয়ারিদ – এর ক্রিয়ামূল ওয়ারাদা’র অর্থ হলো কোন কিছুর কাছে আসা/হাজির হওয়া/পৌছানো। কোন মানুষ বা উট জলাশয়ের কাছে আসে পানি পানের জন্য। ব্যাকরণবিদরা পরিস্কার করেই বলেছেন যে কোন কিছুর কাছে পৌছানো মানেই সেখানে প্রবেশ করা নয়। কোন কিছুর কাছে পৌছানো মানে তার কাছাকাছি যাওয়া।
ফলে যদি বিশ্বাসীরা এমনকি দোযখের কাছেও না যায়, সেখানের ক্ষীণতম শব্দও না শোনে তাহলে দোযখের ভয়ে পুলসিরাতের উপর দিয়ে সন্ত্রস্ত্র হয়ে দৌড়ে যাওয়ার ধারণাটি বোধগম্য হয় না। ২৫:১১-১২ আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়লে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে। আয়াতটির লক্ষ্য যারা দোযখে যাবে তারা।
২৫:১১-১২ কিন্তু উহারা কিয়ামতকে অস্বীকার করিয়াছে এবং যে কিয়ামতকে অস্বীকার করে তাহার জন্য আমি প্রস্তুত রাখিয়াছি জলন্ত অগ্নি। দূর হইতে অগ্নি যখন উহাদের দেখিবে তখন উহারা শুনিতে পাইবে ইহার ক্রুদ্ধ গর্জন ও চীত্কার। যে নরকের গর্জন শুনবে অবিশ্বাসীরা দুর থেকে এবং তার ক্ষীনতম শব্দও যখন শুনতে পাচ্ছে না বিশ্বাসীরা তখন পুলসিরাতের পরীক্ষার বিবরণ, যার নিচে রয়েছে দোযখ, তার অস্তিত্ব নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে বটে।
২.
কোরআনের কয়েকটি আয়াতের সূত্রে পুলসিরাতের ধারণাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে।
১৯:৭০ এবং আমি তো উহাদের মধ্যে যাহারা জাহান্নামে প্রবেশের অধিকতর যোগ্য তাহাদের বিষয় ভাল জানি।
১৯:৭১ এবং তোমাদের (কুম) প্রত্যেকেই উহা অতিক্রম করিবে(আরবী ওযারিদুহা);ইহা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।
১৯:৭২ পরে (সুম্মা) আমি মুত্তাকীদের উদ্ধার করিব এবং জালিমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় রাখিয়া দিব।
প্রথম কথা হলো এই আয়াতে কোথাও পুলসিরাতের উল্লেখ নেই।পুলসিরাতের ধারণা থেকেই অনুবাদে অতিক্রম করার কথা বলা হচ্ছে। আরবী ওয়ারিদুহার অর্থ হবে সেখানে পৌছিবে। মোহাম্মদ আসাদ, পিকথাল, শাকির সহ অনেকেই কাছে পৌছানো অর্থেই অনুবাদ করেছেন। (will come within sight of it- asad, shall approach it- pickthal, shall come to it- shakir.)
দ্বিতীয়ত, যদি আয়াত দুটির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে তোমরা (কুম) বলতে এখানে তাদের কথাই বলা হচ্ছে যারা বিভিন্ন বিভাগ থেকে আসা অবাধ্য ও বিদ্রোহীদের দল। যাদের প্রসঙ্গ এসেছে এর আগের ৬৯ নম্বর আয়াতে।
১৯:৬৯ অতঃপর প্রত্যেক দলের মধ্যে যে দয়াময়ের (রাহমান) প্রতি সর্বাধিক অবাধ্য আমি তাহাকে টানিয়া বাহির করিবই।
ফলে এখানে সর্বনাম তোমরা বলতে সেইসব ধূর্ত নেতা ও তাদের অনুসারীদের কথাই বোঝাচ্ছে যারা সরল পথ প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে গেছে নিরন্তর। (১৯:৬৯) অন্য অনেক আয়াতেও এর সমর্থন আছে যেখানে বলা হচ্ছে পাপীদেরই কেবলমাত্র জাহান্নামের কাছে নেওয়া হবে। ১১:৯৮ সে কিয়ামতের দিন তাহার সম্প্রদায়ের অগ্রভাগে থাকিবে এবং সে উহাদেরকে লইয়া দোযখে প্রবেশ করিবে (ওয়ারাদা)।
১১:৯৮, ২১:১০০ এর একই শব্দমূল ব্যবহূত হয়েছে ১০:৭১ আয়াতে। সব আয়াতই অপরাধ নিয়ে আলোচনা করছে। উদ্দিষ্ট শ্রোতা সবসময়ই পাপীরা। এবং এর কোথাও সবাইকেই দোযখে নেওয়া হবে, কিংবা পুলসিরাত পেরোতো হবে বা এসবের কাছাকাছিও থাকবে ইমানদাররা তার কোন ইঙ্গিত নেই।
পুলসিরাতপন্থীরা ১৯:৭২ আয়াতটির শুরুতে ব্যবহূত অতঃপর (সুম্মা) শব্দটিকে তাদের পক্ষে ব্যবহার করতে চান।
১৯:৭২ পরে (আরবী সুম্মা) আমি মুত্তাকিদেরকে উদ্ধার করিব এবং জালেমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় রাখিযা দিব।
আরবীতে সুম্মা শব্দের অর্থ শুধু অতঃপর নয়। এটা দিয়ে তথাপি এবং কিন্তু অধিকন্তু ইত্যাদিও বোঝায়। শুধু পরম্পরা বা ক্রম বুঝাতে নয়, সমান্তরালতা বা দুটি ঘটনা একই সঙ্গে বর্ণনা করতেও এটা ব্যবহার করা হয় যেখানে ঘটনা দুটি পরপর ঘটেছে এমন নাও হতে পারে। এর বিস্তুর নমুনা কোরআনেই আছে। যেমন ৪১:১১ আয়াতের পর ৪১:১০ আয়াতটি পড়লেও বিষয়টি বোঝা যাবে।
৪১:১১ অতঃপর (আরবী সুম্মা) তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যাহা ছিল ধুম্রপুঞ্জবিশেষ। অতঃপর তিনি উহাকে ও পৃথিবীকে বলিলেন, ‘তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। উহারা বলিল, আমরা আসিলাম অনুগত হইয়া।
৪১:১০ তিনি স্থাপন করিয়াছেন অটল পর্বতমালা ভূপৃষ্ঠে এবং উহাতে রাখিয়াছেন কল্যান এবং চারদিনের মধ্যে ইহাতে ব্যবস্থা করিয়াছেন খাদ্যের সমভাবে, যাঞ্চাকারীদের জন্য।
বক্তব্যে জোর দেওয়ার জন্যও কোরআনে সুম্মা শব্দটির ব্যবহার রয়েছে (১০২)।
তথাপি/এতদসত্বেও/এরপরেও অর্থেও ব্যবহূত হয়েছে (৬:৬৪, ৯:১২৬)। এছাড়াও অধিকন্তু অর্থে (৬:১৫৪, ১১:১), এবং অর্থে (১১:৩) ব্যবহূত হয়েছে শব্দটি। ফলে কোরআনের অপরাপর আয়াতের সাপেক্ষে বলা যায়, ১৯:৭২ আয়াতটি দুটি ঘটনাকে একই সঙ্গে বর্ণনা করছে মাত্র যেখানে বলা হচ্ছে জালেমরা দোযখে যাবে আর ভালো মানুষ বেহেশতে যাবে। ২১:১০১ আয়াতও এটিকে সমর্থন করে।
২১:১০১ যাহাদের জন্য আমার নিকট হইতে পূর্ব হইতে কল্যান নির্ধারিত রহিয়াছে, তাহাদের উহা (জাহান্নাম) হইতে দূরে রাখা হইবে। বিচার দিবসে ন্যায়নিষ্ঠ বিশ্বাসীদের ‘হে প্রশান্ত মন’ এই সম্বোধনে আহ্বান করা হবে (৮৯:২৭)। ফলে এরা সন্ত্রস্ত হয়ে পুলসিরাতের উপর দৌড় দিয়ে যাবে- এমনটা ভাবার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।