দিনের শুরু কি সন্ধ্যায় না ভোরে?

কমনসেন্স বলে দিনের শুরু ভোরে। তবে জনপ্রিয় মুসলিম ধারণা হলো, দিনের শুরু সূর্যাস্তের পর।

যদিও ২৪ ঘন্টার যে দিন সেটা তো যে কোন সময় থেকেই শুরু হতে পারে। অর্থাৎ আপনি চাইলে সকাল ১১টা থেকে পরদিন সকাল ১১টা অব্দি ১ দিন বিবেচনা করতে পারেন। যেমনটা আমরা হিসেবের সুবিধার্থে বিশ্বব্যাপী রাত বারোটার পর থেকে দিন গণনা শুরু করি। যদিও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনাচরণে ভোর বা সকালকেই দিনের শুরু হিসেবে গণ্য করি। এবং কোরআনের আলোকেও দিনের শুরুটাও সূর্যাস্ত নয় বরং সূর্যোদয় (ফজর এর সময়) থেকেই শুরু হওয়া উচিত।

এর সমর্থনে নিচের পয়েন্টগুলো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে:

১. দিনে যদি ৫ বার প্রার্থনা হয়ে থাকে এবং জনপ্রিয় মুসলিম ধারণা অনুযায়ী দিনের শুরু যদি সূর্যাস্ত থেকে বিবেচনা করা হয়, তাহলে এশার সালাত হবে ওই দিনের প্রথম নামাজ। এটা মেনে নেওয়া কঠিন। কারণ-

২. মধ্যবর্তী নামাজের যে উল্লেখ রয়েছে ২:২৩৮ আয়াতে সেটাকে একটি দিনের সকল নামাজের মধ্যখানেই থাকা বাঞ্ছনীয়। ৫ ওয়াক্ত নামাজকে বিবেচনায় নিলে এই মধ্যবর্তী সালাতটি হলো আসরের নামাজ। এর পরেই আসে মাগরিব ও এশা, এবং এর আগে থাকে ফজর ও জোহর।

২:২৩৮ তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হইবে বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াইবে।

৩. ৯১:১-৪ আয়াত থেকে বোঝা যায় দিনের সম্পর্ক ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে যা প্রাক-ভোর থেকে সূর্য পুরো উদিত হওয়া অব্দিকে বোঝায়। দিন বা ‘নাহার’ এর সমাপন হয় রাতের (লাইল) সুচনায়। তবে এটা দিয়ে দিন (ইয়াওম) পূর্ণ হলো এটা বোঝায় না। পুরো দিনের হিসেবের মধ্যে রাতও থাকে পরবর্তী প্রাক-ভোরের আলো ফোটা অব্দি।

৯১:১-৪ শপথ সূর্যের এবং উহার কিরণের। শপথ চন্দ্রের, যখন উহা সূর্যের পর আবির্ভূত হয়। শপথ দিবসের (আরবী নাহার), যখন সে উহাকে প্রকাশ করে। শপথ রজনীর, যখন সে উহাকে আচ্ছাদিত করে।

৪. ১১:১১৪ আয়াতেও দিবসের (আরবী নাহার) দুই প্রান্তে সালাত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, এবং সেই সঙ্গে বলা হয়েছে রাতের সালাতের কথা। সুতরাং রাতের নামাজ দিনচক্রের অন্তর্গত হিসেবেই বিবেচ্য, পরের দিনের প্রারম্ভিক সালাত হিসেবে নয়।

১১:১১৪ (অংশবিশেষ) তুমি সালাত কায়েম কর দিবসের (আরবী নাহার) দুই প্রান্তভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে (আরবী ওয়া-যুলাফান মিনাল লাইল)।

৫. ৬৯:৭ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, আদ জাতি নির্মূল হয়েছিল ৭ রাত ও ৮ দিনের বিরামহীন ঝঞ্ঝাবায়ূ দ্বারা।

৬৯:৬-৭ আর আদ সম্প্রদায়, উহাদিগকে ধ্বংস করা হইয়াছিল এক প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ু দ্বারা। যাহা তিনি উহাদের উপর প্রবাহিত করিয়াছিলেন সপ্তরাত্রি ও অষ্টদিবস (আরবী আয়্যাম) বিরামহীনভাবে (আরবী হুসুম); তখন তুমি উক্ত সম্প্রদায়কে দেখিতে- উহারা সেথায় লুটাইয়া পড়িয়া আছে সারশুন্য খর্জুর কাণ্ডের ন্যায়।

দিন (ইয়াওম) যদি শুরু হতো রাতে (সূর্যাস্তের পর) তাহলে অষ্টম দিন শুরু হবে অষ্টম রাতে এবং তা চলবে অষ্টম রাত অব্দি। অর্থাৎ অষ্টম রাতে প্রবেশ না করে অষ্টম দিন শুরু হতে পারে না। কিন্তু দিনকে (ইয়াওম) যদি ভোর (ভোর) থেকে বিবেচনা করি তাহলে অষ্টম দিনের শুরু হবে অষ্টম ভোরে কিন্তু এর আগে থাকবে ৭ রাত (যেমনটা ৬৯:৭ আয়াতে বলা হয়েছে) এবং অষ্টম দিন অষ্টম রাতে প্রবেশ করবে না।

কাজেই, কোরআনের তথ্য বিশ্লেষণ করে মোটামুটি এটাকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় যে, দিনের শুরু ভোর (ফজর) থেকেই।

৬. সুরা ক্বদরের ৯৭:৫ আয়াতও নির্দেশ করে যে দিনের শুরু ভোর থেকেই (সালামুন হিয়া হাত্তা মাতলাইল ফজর – শান্তিই শান্তি, সেই রজনী উষার আবির্ভাব পর্যন্ত)। সুরার ১-৪ আয়াতে একটি মহিমান্বিত রাতের কথা বলা হচ্ছে। ভোরের আবির্ভাবের সীমানা এবং নতুন দিনের সূচনার সাথে এর জোরালো ইঙ্গিত লক্ষ্যনীয়।

৭. রোজা শুরু হয় ফজর বা ভোর থেকে (২:১৮৭) এবং শেষ হয় রাতে (আরবী লাইল), সূর্যাস্তে নয়। দিনের হিসাব যদি সূর্যাস্ত থেকে শুরু হতো তাহলে রোজা দিনের মাঝখান থেকে শুরু হয়। সেক্ষেত্রে রোজার রাত টার্মটা ঠিক খাপ খায় না।

যেমন, ২:১৮৭ আয়াতে রোজার রাতে স্ত্রীসম্ভোগ বৈধ করা হয়েছে। যদি, যেভাবে বলা হচ্ছে, দিন যদি প্রথম রোজার আগে শুরু হয়, তাহলে এই রাতটি ‘রোজার রাতের’ সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না। কারণ অনুমতির আলোকে বিবেচনা করলে, প্রকৃত রোজা শুরুর আগেই এ ধরনের অনুমতি অর্থহীন মনে হবে। তবে, রোজা শুরু হয়ে গেলে, তখন রাতের সম্পর্কের একটা ব্যাখ্যা মেলে। অর্থাৎ রোজা শুরু হওয়ার পর থেকে এটি নিষিদ্ধ, সেটি বোধগম্য।

৮. ২:১৮৪ আয়াতে বলা হচ্ছে রোজা কতিপয় দিবসের (আয়্যামান) জন্য। এখানেও ইঙ্গিত রয়েছে যে রোজার যে দিনটি শুরু হবে তা প্রারম্ভ হচ্ছে ভোর (ফজর ২:১৮৭)।

৯. ২৫:৪৭ আয়াতে মৃত্যুর সাথে ঘুমের এবং জাগরণের সাথে পুনর্জাগরণের একটা সাদৃশ্য দেখানো হয়েছে। এখানে দিনকে (নাহার) একটা নতুন শুরু, নতুন সময়, নতুন জাগরণ বা পুনর্জাগরণের (নুশুর) সঙ্গে যুগলবন্দী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতের আলোকেও এটা বলা যায় যে, রাত হলো একটি সময়কাল বা দিনের সমাপ্তি এবং দিন হলো নতুন শুরু বা নবযাত্রার সমার্থক।

২৫:৪৭ এবং তিনিই তোমাদের জন্য রাত্রিকে (আরবী লাইল) করিয়াছেন আবরণস্বরুপ, বিশ্রামের জন্য তোমাদের দিয়াছেন নিদ্রা এবং সমুত্থানের (আরবী নুশুর) জন্য দিয়াছেন দিবস (আরবী নাহার)।

যদিও সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার মাধ্যমে পরবর্তী আরবী মাসের শুরু বোঝা যায়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এটা একটি নতুন দিনের সূচনা করে। এ দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে, যে পার্থকের বিষয়টি উপরোক্ত আলোচনায় খোলাসা করা হয়েছে কোরআনের আলোকে।

চিরায়ত আরবী ভাষার প্রেক্ষিতে এটাও বোধগম্য যে নতুন দিনের সূচনা ভোরে এবং দিন কেবলমাত্র তখনই থাকে যতক্ষণ সূর্য পৃথিবীর উপরে দৃশ্যমান থাকে। ইয়াওমুন এর অর্থ ব্যাখ্যা করতে অভিধানে বলা হচ্ছে – মিনিং দি পিরিয়ড ফ্রম দি রাইজিং অফ দি সান টু ইটস সেটিং; ডন টু সানসেট। (দেখুন এডোয়ার্ড লেনের লেক্সিকন ভলিউম ৮ পৃষ্ঠা ৩০৬৪)

কাজেকাজেই
মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত যে বিশ্বাস, দিনের শুরু সন্ধ্যা বা সূর্যাস্ত থেকে কোরআনে তার কোন সমর্থন নেই। বরং কোরআনের আয়াত বিচার করলে দেখা যায়, সূর্যোদয় থেকেই দিনের শুরু হয়। দিনের সমাপ্তি ঘটে সূর্যাস্তকালে। চিরায়ত আরবী অভিধানগুলোও এ মতকে সমর্থন করে।

সূত্র: https://quransmessage.com/articles/new%20day%20FM3.htm

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top