মুসলিম মানসে জিব্রাইল বা জিব্রিল একজন গুরুত্বপূর্ণ ফেরেশতা হিসেবেই অধিষ্ঠিত। অনেকেই তাকে ফেরেশতাদের নেতা মনে করেন। কিন্তু কোরআনে এই ধারণার পক্ষে কোন শক্ত সমর্থন নেই।
কোরআনে জিব্রাইলের নাম উল্লেখ করে আয়াত এসেছে তিনবার। আয়াতগুলো দেখা যাক:
২:৯৭ বল, যে কেহ জিবরীলের শত্রু এইজন্য যে সে আল্লাহর নির্দেশে তোমার হূদয়ে কুরআন পৌছাইয়া দিয়াছে, যাহা উহার পূর্ববর্তী কিতাবের সমর্থক এবং যাহা মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও শুভ সংবাদ-
২:৯৮ যে কেহ আল্লাহর, তাঁহার ফিরিশতাগণের, তাঁহার রাসুলগণের এবং জিবরীল ও মীকাঈলের শত্রু, সে জানিয়া রাখুক, আল্লাহ নিশ্চয় কাফিরদের শত্রু।
৬৬:৪ যদি তোমরা উভয়ে অনুতপ্ত হইয়া আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর তবে ভাল, কারণ তোমাদের হূদয় তো ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু তোমরা যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরের পোষকতা কর তবে জানিয়া রাখ, আল্লাহই তাহার বন্ধু এবং জিবরাঈল ও সত্কর্মপরায়ণ মুমিনগণও, তাহা ছাড়া অন্যান্য ফিরিশতাও তাহার সাহায্যকারী।
লক্ষ করবেন, শেষের দুটি আয়াতে ফেরেশতাদের কথা এবং জিব্রাইলের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৬৬:৪ আয়াতে ‘অন্যান্য’ শব্দটি অনুবাদকের ধারণা অনুযায়ী যুক্ত হয়েছে। মুল আরবীতে শুধু ওয়াও রয়েছে। ফলে অর্থ দাড়াবে এবং ফিরিশতারাও তাহার সাহায্যকারী।
২:৯৮ আয়াতে কাফিরদের শত্রু হিসেবে পরিস্কারভাবে যে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে তা এরকম : ১. আল্লাহ. ২. ফেরেশতাগণ. ৩. রাসুলগণ. ৪. জিব্রাইল, ৫. মিকাইল।
৬৬:৪ আয়াতেও শ্রেণীবিন্যাস এরকম: ১. আল্লাহ ২. জিব্রাইল ৩. সত্কর্মপরায়ণ মুমিনগণ ৪. ফেরেশতাগণ
সত্যের খাতিরে এখানে বলে রাখা দরকার যে আরবী ওয়াও (এবং) ক্ষেত্রবিশেষে জোর দেওয়া বা বিস্তারিত বর্ণনার ক্ষেত্রেও ব্যবহূত হয়। (৫৫:৬৮ কিংবা ২:২৩৮-২৩৯)। সে বিচারে জিব্রাইল ফেরেশতা কিংবা ফেরেশতা নন তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
পবিত্র আত্মা
২:৯৭ এবং ১৬:১০২ আয়াত দুটি পাঠ করলে এক আশ্চর্য সমাপতন লক্ষ্য করা যায় যেখানে জিব্রাইল ও পবিত্র আত্মা উভয়কে আল্লাহর অনুমতিক্রমে কোরআনের প্রত্যাদেশ বহন করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২:৯৭ বল, যে কেহ জিবরীলের শত্রু এইজন্য যে সে আল্লাহর নির্দেশে তোমার হূদয়ে কুরআন পৌছাইয়া দিয়াছে, যাহা উহার পূর্ববর্তী কিতাবের সমর্থক এবং যাহা মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও শুভ সংবাদ-
১৬:১০২ বল, তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে রুহুল কুদুস জিবরাইল সত্যসহ কুরআন অবতীর্ণ করিয়াছে, যাহারা মুমিন তাহাদিগকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য এবং হিদায়াত ও সুসংবাদস্বরুপ মুসলিমদের জন্য।
(উল্লেখ্য ১৬:১০২ আয়াতের মূল আরবীতে শুধু রুহুল কুদুস শব্দটি আছে। জিব্রাইলের উল্লেখ নেই।)
উপরের আয়াতগুলো থেকে সহজেই অনুমেয় জিব্রাইলই রুহুল কুদুস। রুহুল কুদুসকে কোরআনের কোথাও ফেরেশতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি বা রুহুল কুদুস বা জিব্রাইল ফেরেশতাদের শ্রেণীভূক্ত এরকম কোন আভাস দেওয়া হয়নি।
নিচের আয়াতগুলোতে রুহ সংক্রান্ত বিবরণ পড়লেও সহজেই অনুমান করা যায় যে আত্মা ফেরেশতাদের শ্রেনীভূক্ত বিষয় নয়।
৭৮:৩৮ সেই দিন রুহ ও ফিরিশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াইবে; দয়াময় যাহাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত অন্যেরা কথা বলিবে না এবং সে যথার্থ বলিবে।
১৬:২ তিনি তাঁহার বান্দাদের মধ্যে যাহার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশ ওহীসহ (আরবী বিল-রুহি) ফিরিশতা প্রেরণ করেন এই বলিয়া যে, তোমরা সতর্ক কর যে, নিশ্চয়ই আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই; সুতরাং আমাকেই ভয় কর।
৭০:৪ ফিরিশতা এবং রূহ আল্লাহর দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন এক দিনে যাহার পরিমাণ পার্থিব পঞ্চাশ হাজার বত্সর।
৯৭:৪ সেই রাত্রিতে ফিরিশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাহাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।
আরেকটি আয়াতে পবিত্র আত্মাকে বিশ্বস্ত আত্মা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যিনি নবীর নিকট প্রত্যাদেশ পৌছে দিয়েছিলেন। এ থেকেও মনে হয় জিব্রাইলই সেই বিশ্বস্ত আত্মা।
২৬:১৯২-১৯৫ নিশ্চয়ই আল কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালক হইতে অবতীর্ণ। জিবরাইল ইহা লইয়া অবতরণ করিয়াছে। তোমার হূদয়ে, যাহাতে তুমি সতর্ককারী হইতে পার। অবতীর্ণ করা হইয়াছে সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়। (মূল আরবীতে রুহুল আমিন যার অর্থ বিশ্বস্ত আত্মা। অনুবাদক নিজ দায়িত্বে সেটি বদলে জিবরাইল শব্দটি প্রয়োগ করেছেন।)
বাইবেলের বর্ণনায়
বাইবেলে জিব্রাইলকে গ্যাব্রিয়েল হিসেবে উল্লেক করা হয়েছে। নিউ টেস্টামেন্টের একটি বর্ণনায় যেখানে গ্যাব্রিয়েলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে কোরআনের বর্ণনার সঙ্গে সুক্ষ পরিবর্তন লক্ষণীয়।
লুক ১:২৬-৩৪
পরে ষষ্ঠ মাসে গ্যাব্রিয়েল দূত ঈশ্বরের নিকট হইতে গালীল দেশের নাসরত্ নামক নগরে একটি কুমারীর নিকটে প্রেরিত হইলেন, তিনি দায়ূদ-কুলের যোষেফ নামস পুরুষের প্রতি বাগদত্তা হইয়াছিলেন; সেই কুমারীর নাম মরিয়ম। দূত গৃহমধ্যে তাঁহার কাছে আসিয়া কহিলেন, অয়ি মহানুগৃহীতে, মঙ্গল হউক, প্রভু তোমার সমবর্ত্তী। কিন্তু তিনি সেই বাক্যে অতিশয় উদ্বিগ্ন হইলেন, আর মনে মনে আন্দোলন করিতে লাগিলেন, এ কেমন মঙ্গলবাদ? দূত তাহাকে কহিলেন, মরিয়ম, ভয় করিও না, কেননা তুমি ইশ্বরের নিকটে অনুগ্রহ পাইয়াছ। আর দেখ, তুমি গর্ভবতী হইয়া পুত্র প্রসব করিবে, ও তাহার নাম যীশু রাখিবে। তিনি মহান হইবেন, আর তহাকে পরাত্পরের পুত্র বলা যাইবে; আর প্রভু ইশ্বর তাহার পিতা দায়ূদের সিংহাসন তাহাকে দিবেন; তিনি যাকোব-কুলের উপরে যুগে যুগে রাজত্ব করিবেন ও তাহার রাজ্যের শেষ হইবে না। তখন মরিয়ম দূতকে কহিলেন, ইহা কিরুপে হইবে? আমি ত পুরুষকে জানি না।
কোরআনের বর্ণনার সঙ্গে এই বর্ণনা মিলিয়ে পড়লে লক্ষ্য করবেন কোরআনে শুধু রুহ শব্দটি ব্যবহূত হয়েছে, ফেরেশতার কোন উল্লেখ সেখানে নেই।
১৯:১৭-২১ অতঃপর উহাদিগ হইতে সে পর্দা করিল। অতঃপর আমি তাহার নিকট আমার রুহকে পাঠাইলাম, সে তাহার নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করিল। মারইয়াম বলিল, আল্লাহকে ভয় কর যদি তুমি মুত্তাকী হও, আমি তোমা হইতে দয়াময়ের (রাহমানের) শরণ লইতেছি। সে বলিল, আমি তো তোমার প্রতিপালক-প্রেরিত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করিবার জন্য। মারইয়াম বলিল, কেমন করিয়া আমার পুত্র হইবে যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করে নাই এবং আমি ব্যভিচারিণীও নহি? সে বলিল, এইরুপেই হইবে। তোমার প্রতিপালক বলিয়াছেন, ইহা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমি উহাকে এইজন্য সৃষ্টি করিব যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার নিকট হইতে এক অনুগ্রহ; ইহা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।
১৯:১৭ আয়াতে রুহ এর উল্লেখ সুচিন্তিত ও ইচ্ছাকৃত যা ৩:৪৫ আয়াতে বর্ণনার সম্পূর্ণ বিপরীত যেখানে একটা ভিন্ন সময়ে একই ঘটনার বর্ণনায় ফেরেশতাদের উল্লেখ দেখা যাচ্ছে।
৩:৪৫ স্মরণ কর, যখন ফিরিশতাগণ বলিল, হে মারইয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে তাঁহার পক্ষ হইতে একটি কলেমার সুসংবাদ দিতেছেন। তাহার নাম মসীহ মারইয়াম-তনয় ঈসা, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তগণের অন্যতম হইবে।
আয়াত দুটি থেকে অনুমেয় ১৯:১৭ আয়াতে যিনি মরিয়মের কাছে গিয়েছিলেন তিনি কোন ফেরেশতা নন, বরং রুহ। বাইবেলের বর্ণনা মেনে নিলে বলতে হয় পুত্রের সুসংবাদ দিতে গিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল। কিন্তু কোরআনের বর্ণনায় সেটি রুহ।
যা হোক, কোরআনের বর্ণনায় ১৯:১৭ আয়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেরেশতা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু ৩:৪৫ আয়াতে করা হয়েছে, সম্ভবত বাইবেলের বর্ণনায় গ্যাব্রিয়েলকে ফেরেশতা হিসেবে উল্লেখের সংশোধন করে।
কোরআনের ৭৭:৫ আয়াতের ব্যাখ্যায় অনেকে, বিশেষ সমালোচক খৃস্টানরা, বলেন যে এ আয়াতে কোরআনের আয়াত নাযিলের সঙ্গে একাধিক ফেরেশতা জড়িত ছিলেন। এ ব্যাখ্যা ২:৯৭, ১৬:১০২ ও ২৬:১৯৩ আয়াতের সঙ্গে অসঙ্গিতপূর্ণ।
মূলত ৭৭:৫ আয়াতে কোন ফেরেশতার কথা সরাসরি বলা হয়নি। ওহী নাযিলের কথাও এখানে নেই। এখানে স্রেফ কোরআনের বার্তা প্রচার বা ছড়িয়ে দেওয়ার কথাই বলা হয়েছে।
৭৭:৫ এবং শপথ তাহাদের যাহারা মানুষের অন্তরে পৌছাইয়া দেয় উপদেশ-
২:৯৭, ১৬:১০২ ও ২৬:১৯৩ আয়াতে নবীর কাছে কোরআন পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে নাযযালা বা নাযালা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ৭৭:৫ আয়াতে তা হয়নি। এখানে ক্রিয়াপদ আলক্বা ব্যবহার করা হয়েছে যার মানে নিক্ষেপ করা, জ্ঞাপন করা, প্রদান করা ইত্যাদি। ফলে প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে পরিস্কার হয় এটি নবীর কাছে প্রত্যাদেশ আনা সংক্রান্ত কোন আয়াত নয়। ফলে এটা নিশ্চিত যে একজন ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্বই আল্লাহর আদেশক্রমে কোরআন নবীর কাছে পৌছে দিয়েছিলেন। এবং কোরআনে কখনো তাকে ফেরেশতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।