জান্নাতের হুর

পুরুষদের জন্য বেহেশতে থাকবে চিরকুমারী হুর, এরকমটাই শুনে আসছি। সত্যিই কি তাই?

অধিকাংশ হুজুরদের ওয়াজ শুনলে মনে হয় বেহেশত পুরুষদের সম্ভোগের জায়গা। ওমর খৈয়ামের খাও দাও ফুর্তি করোর এক বাধাবন্ধনহীন দুনিয়া। বিভিন্ন সেকেন্ডারি সোর্সের বিবরণ পড়ে এরকম ধারণা পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মুসলিমদের প্রাইমারি সোর্স কোরআন কী বলে? হুরের বিবরণ সেখানে আসলে কীরকম?

হুজুরদের ওয়াজে কিংবা বিভিন্ন সেকেন্ডারি সোর্সে হুরদের যে ভলাপচুয়াস বিবরণ মেলে কোরআনের বর্ণনা তার ধারে কাছেও নেই। এমনকি হুর শব্দটি যে নারীবাচকই হবে সেটাও খুব সুনির্দষ্টি নয় কোরআনে। পুরুষকেন্দ্রিক পক্ষপাতই শব্দটিকে নারী হিসেবে উপস্থাপিত করেছে আমাদের সামনে, এরকমটা মনে হয়।

প্রথম কথা, হুর শব্দটি বহুবচন। একবচনে আহওয়ার (পুরুষবাচক) এবং হাওরা (নারীবাচক)। এ দুয়েরই বহুবচন হুর। আক্ষরিকভাবে এর অর্থ সাদা-চোখের বা যাদের চোখের সাদা অংশটা খুব সাদা, কালো অংশটা খুব কালো এমন মানুষ। আরবী বাগধারায় সাধারণভাবে এটি শুদ্ধতার ধারণাকে প্রকাশ করে। তাই শব্দটির সঠিকতর অনুবাদ বিশুদ্ধ সঙ্গী/পবিত্র সঙ্গী/সত্সঙ্গী/সহকারী/বন্ধু ইত্যাদি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। মোহাম্মদ আসাদ, মার্মাডিউক পিকথালসহ কোরআনের অনেক অনুবাদকই এভাবেই শব্দটির অনুবাদ করেছেন। যেমন মোহাম্মদ আসাদ ৪৪:৫৪ আয়াতটির অনুবাদ করেছেন

Thus shall it be. And We shall pair them with companions pure, most beautiful of eye. (Muhammad Asad)

উলে্লখ্য

অধিকাংশ ক্ষেত্রে, ওয়াকিয়া সুরায় ৫৬:৩৫ আয়াতের অনুবাদে ভুলভাবে হুরের কথা উলে্লখ করা হয়। অথচ আয়াতে হুর শব্দটিরই কোন অসি্তত্ব নেই। প্রেক্ষাপটসহ ভাল করে পড়লে বিষয়টি পরিস্কার হবে যে, এখানে বলা হয়েছে ডান দিকের লোকদের ব্যাপারে অর্থাত্ নারী এবং পুরুষ যারাই বেহেশতে যাবেন তাদের কথা।

এই আয়াতগুলিতে একথাও পরিস্কার বলা হয়েছে যে, যারা বেহেশতে যাবেন, তাদের নতুন করে তৈরি করা হবে। (৫৬:৩৫), নতুন এই সৃষ্টির কথা বোঝানোর জন্য তুলনা দেওয়া হয়েছে, যেরকম কুমারী যাদের কেউ স্পর্শ করেনি (৫৬:৩৬), সমবয়সী (৫৬:৩৭)। এর সবটাই ডান দিকের নারী-পুরুষ সবাইকে লক্ষ্য করে বলা।

সুরার ২৭ থেকে ৩৪ পর্যন্ত পড়া যাক।

৫৬:২৭-৩৪

আর ডানদিকের দল! কত ভাগ্যবান ডানদিকের দল! তাহারা থাকিবে এমন উদ্যানে যেখানে আছে কন্টকহীন কুলবৃক্ষ।

কঁাদিভরা কদলীবৃক্ষ। সম্প্রসারিত ছায়া। সদা প্রবহমান পানি। ও প্রচুর ফলমূল। যাহা শেষ হইবে না ও যাহা নিষদ্ধিও হইবে না। আর সমুচ্চ শয্যাসমূহ।

৫৬:৩৫

উহাদেরকে আমি সৃষ্টি করিয়াছি নতুন রুপে।

এখানে না বোঝার কি কোন অবকাশ আছে যে, হুর নয়, ডানদিকের সকল মানুষকে নতুন রুপে সৃষ্টি করার কথাই বলা হয়েছে।

এর পরের আয়াতেই বলা হয়েছে

৫৬:৩৬

আমরা তাদের করেছি কুমারী (আরবী আবকারান – মূল: বা কাফ রা)

বা কাফ রা মূলের এই শব্দের অর্থ কুমারী, অস্পর্শিত, নতুন, টাটকা ইত্যাদি। একেবারে নতুন কিছু বোঝাতে অনেক ভাষাতেই ভার্জিন শব্দটির ব্যবহার রয়েছে।

৫৬:৩৭

একনিষ্ঠ। সমবয়সী।

(অনুবাদে সাধারণত সমবয়স্কা লেখা হয়, হুরকে নারী বিবেচনায়। কিন্তু মূল আরবী শব্দটি দেখতে পাচ্ছি আতরাবান যেটি পুংলিঙ্গবাচক।)

৫৬:৩৮

ডান দিকের মানুষেরা। (লিআসহাবিল ইয়ামিনের অনুবাদ তুলনার জন্য দেখতে পারেন ৬৭:১১ আয়াতটি)

এই ডান দিকের মানুষ হবেন আগের জেনারেশন এবং পরের জেনারেশন থেকে। এখানেও কিন্তু নারী পুরুষ সবার কথাই বলা হয়েছে। (৫৬:৩৯-৪০)

মোদ্দা কথা, এই আয়াতগুলিতে বেহেশতের নতুনভাবে সৃষ্ট মানুষের কথাই বলা হয়েছে। এবং বেহেশতের পুরস্কার কেবল পুরুষদের জন্য নয়, নারীদের জন্যও, এ কথা পরিস্কারভাবে কোরআনে উলে্লখ আছে বিভিন্ন স্থানে। যেমন :

৯:৭২ (অংশ)

আল্লাহ মুমিন নর ও নারীকে প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন জান্নাতের- যাহার নম্নিদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তাহারা স্থায়ী হইবে।

১৬:৯৭

পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেহ ভাল কাজ করবে এবং বিশ্বাসী তাহাকে আমি নিশ্চয়ই উত্তম জীবন দান করিব এবং তাহাদেরকে তাহাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করিব।

তাহলে

কোরআনে কি নারী সঙ্গীর কথা নেই? আছে। অন্তত একটা ইঙ্গিতের দেখা মেলে ৭৮:৩৩ আয়াতে যেখানে সমবয়সী তরুনী (আরবী কাওয়ায়িবা) শব্দটি আছে। তবে একইসঙ্গে এটাও বলা যায়, আলাদা করে পুরুষ সঙ্গীর কথাও বলা হয়েছে ৭৬:১৯ আয়াতে যেখানে চিরকিশোরগণ (আরবী উইলদানুন) শব্দটি আছে। সুতরাং ৭৮:৩৩ আয়াতের ভিত্তিতে হুর বলতে কেবল নারী বোঝানোর কোন সুযোগ নেই, কারণ সেক্ষেত্রে ৭৬:১৯ আয়াতের মাধ্যমে হুরকে পুরুষ বলেও বোঝানো সম্ভব।

আমাদের বর্তমান দুনিয়ার বিবেচনায় পরবর্তী জীবনকে বোঝার সুযোগ কম বলেই মনে হয়। সেই স্পিরিচুয়াল জগতের রুপরসগন্ধবর্ন আমাদের বর্তমান জীবনের পঞ্চেন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। সেখানকার সুখ বা প্রাচুর্যের প্রকৃতি ভিন্নতর। যে সত্তা (নাফস) থেকে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্ম এই পৃথিবীতে, সেই সত্তাই ফিরে যাবে সৃষ্টিকর্তার কাছে। তাকে তিনি ফের কী রুপ দেবেন তা তিনিই ভাল জানেন।

৫৬:৩৫ এর মতো আয়াতের ভিত্তিতে অনেকে মনে করেন, পরবর্তী জীবনে বেহেশেতে আমাদের সত্তা যে নতুন রুপ পাবে সেটি আমাদের বর্তমান পৃথিবীর মতো লিঙ্গনির্ভর নাও হতে পারে। বর্তমান পৃথিবীর ভাষার সীমাবদ্ধতায় সেই সত্তার রুপ প্রকাশ হয়তো সম্ভব নয়। তাছাড়া, আরবীতে ক্লীবলিঙ্গের ব্যবহার নেই। সেখানে সবকিছুই, এমনকি জড় বস্তুও হয় পুরুষবাচক নয়তো নারীবাচক। যেমন সূর্য পুংলিঙ্গ আবার চঁাদ স্ত্রীলিঙ্গ।

এসব কারণেও আরবী ভাষার আচারে একে স্ত্রীবাচক (আবকারান, কাওয়ায়িবা ইত্যাদি) মনে হলেও মূলগত অর্থে হুর বলতে পবিত্র সঙ্গী হিসেবেই বিবেচনা করা সঙ্গত, যার প্রকৃত স্বরুপ পরকালেই উপলদ্ধি করা যাবে।

Scroll to Top