চাঁদ দেখা কিংবা চাঁদপুরের ঈদ

কোরআনে যা স্পষ্ট করে বলা আছে সেসব বিষয়কেও জটিল করে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের মুনশিয়ানা অতুলনীয়। ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে সাধারণত মুসলিমদের ঝোঁক থাকে নিজ এলাকার ঐতিহ্যের দিকে। স্থানীয় মসজিদের ইমাম কী বললেন কিংবা দেশের প্রধান মসজিদের খতিবের নির্দেশনা কী সেসবকেই পালনীয় মনে করেন তারা। কিন্তু কোরআনে পরিস্কারভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার আচরণ ও সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী করা হয়েছে। ব্যক্তি নিজে যেটা সত্যি বলে উপলদ্ধি করবে সেটিকেই মেনে চলার দায়িত্ব তার। অন্ধ অনুসরণের কোন সুযোগ সেখানে রাখা হয়নি।

বিশ্বাসীদের কর্তব্য কোরআনের আয়াতের সর্বোত্তম অর্থ অনুসন্ধান বা উপলদ্ধি করা।

৩৯:১৮ যাহারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে (কোরআনের) এবং উহার মধ্যে যাহা উত্তম তাহা গ্রহণ করে। উহাদিগকে আল্লাহ সত্পথে পরিচালিত করেন এবং উহারাই বোধশক্তিসম্পন্ন (আরবী আলবাব)।

এখন দেখা যাক চাদ দেখা সম্পর্কে কোরআনে কী বলা হয়েছে।

২:১৮৯ লোকে তোমাকে নতুন চাঁদ (আরবী আহিলাতি) সম্বন্ধে প্রশ্ন করে। বল, উহা মানুষ এবং হজ্জের জন্য সময়-নির্দেশক (আরবী মাওয়াক্বিতু)। পশ্চািদক দিয়া তোমাদের গৃহে প্রবেশ করাতে কোন পূণ্য নাই; কিন্তু পূণ্য আছে কেহ তাকওয়া অবলম্বন করিলে। সুতরাং তোমরা দ্বার দিয়া গৃহে প্রবেশ কর, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাহাতে তোমরা সফলকাম হইতে পার।

আহিল্লাহ (নতুন চাঁদ) মানে কী?
আহিল্লাহ আরবী হিলাল শব্দের বহুবচন যার অর্থ প্রতীয়মান হওয়া, সম্মুখে আসা, উদিত হওয়া, প্রকাশিত হওয়া ইত্যাদি। এর সাথে নতুন চাঁদের হাজির হওয়ার সম্পর্কটি উল্লেখযোগ্য।
[সূত্র: জন পেনরিসের এ ডিকশনারি অ্যান্ড গ্লসারি অফ দি কোরান (পৃ ১৫৪), এডোয়ার্ড লেনের লেক্সিকন (অষ্টম খণ্ড ৩০৪৪), হান্স ওয়েহর এর মডার্ন রিটেন অ্যারাবিক (পৃ ১০৩০)।]

উপরোক্ত অভিধানত্রয়ীর আলোকে আহিল্লাহ শব্দটির মূল অর্থ নতুন চাঁদ দর্শন সম্পর্কিত বটে। শব্দটির এ অর্থ বুঝলে আয়াতটির অর্থ বোঝাও সহজ হয়। যেমন, ইসলামের প্রথম যুগে দূর দূর দেশে অনেক পর্যটক উট বা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে কিংবা জাহাজে চড়ে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতেন। বিভিন্ন দেশে গিয়ে কোরআনের বাণী পৌছে দিতেন তারা। যাদের অনেকেই কোরআনকে সত্য বলে কবুল করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। যখন সেসব এলাকায় রমজান মাস উপস্থিত হতো তখন স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখেই তারা রোজা রাখা শুরু করতেন।

আধুনিক যুগের জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতি, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশ্বকে বিশ্বগ্রামে পরিণত করেছে। তত্রাচ, আকাশের গ্রহ নক্ষত্র নিজস্ব নিয়মেই বহমান। যদিও অনেকে বলেন নয়া প্রযুক্তির আলোকে আমরা এখন চাঁদ দেখার মতো কাজগুলো সার্বজনীন করে তুলতে পারি, তবু বিষয়টি তর্কসাপেক্ষ। কোরআনের আলোকে এরকম প্রস্তাব মেনে নেওয়া কঠিন। স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখার ব্যবস্থাপনাকে মেনে নেওয়াই বিধেয়। কোন এলাকা থেকে যদি চাঁদ দেখা না যায় তাহলে বিজ্ঞানের উন্নতির সহায়তায় ভুগোলকের অন্য কোথাও থেকে সেটা দেখে সময় নির্দেশ করার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না।

এটা বোঝা দরকার যে আকাশের গ্রহ নক্ষত্র নির্দিষ্ট সময়ের সীমা নির্দেশ সূচক (১০:৫, ৬:৯৭, ১৭:১২)। এবং বিজ্ঞানের উন্নতি সত্ত্বেও তাদের হ্রাস-বৃদ্ধি স্থানীয়ভাবেই দর্শনীয়। পৃথিবীতে কোথাও একটি নির্দিষ্ট সময়েই সূর্য উদিত বা অস্ত যায় না। একই কথা চন্দ্রের কথাও সত্য। চন্দ্র-সূর্যের উদয়-অস্তের সঙ্গে নামাজ রোজা সহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত। এটা দেশ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন সময়েই হয়ে থাকে। আমরা কেউ সৌদি আরবের সাথে সময় মিলিয়ে বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজ আদায় করি না।

একইভাবে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি সত্ত্বেও চাঁদ দেখার বিষয়টিও স্থানীয় ঘটনা। চিরকাল চাঁদ সূর্য যেভাবে চলতো এখনো সেভাবেই চলছে।

৩৬:৪৮-৪০ আর সূর্য ভ্রমণ করে উহার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, ইহা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। এবং চন্দ্রের জন্য আমি নির্দিষ্ট করিয়াছি বিভিন্ন মনযিল; অবশেষে উহা শুস্ক, বক্র, পুরাতন খর্জুর শাখার আকার ধারণ করে। সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া এবং রজনীর পক্ষে সম্ভব নয় দিবসকে অতিক্রম করা; এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে সন্তরণ করে।

মোদ্দাকথা, কোন বিজ্ঞান পরিষদ কিংবা কোন নির্দিষ্ট এলাকার ইমাম কী বললেন সেটা ধর্তব্য নয়। চন্দ্র সূর্যের মতো গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে আমাদের কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক ধর্মীয় আচারের সময় নির্ধারণ করা কর্তব্য। যেহেতু এ ব্যাপারে কোরআনে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।

চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন দেশ মজলিসে শুরা বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে পারে সূক্ষভাবে পর্যবেক্ষণের কাজটি করার জন্য। এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারও করা যেতে পারে। বিশেষ করে প্রতিকূল আবহাওয়ার ক্ষেত্রে। বিজ্ঞানের চর্চাকে কোরআনে উত্সাহিত করা হয়েছে। এবং সেসব ব্যবহার করে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বানও রয়েছে।

সুতরাং বিজ্ঞানের চর্চা আমরা করব কিন্তু কোরআনের মূল নির্দেশনাকে অবুঝের মতো অতিক্রম করার দুর্মতি যেন আমাদের না হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top