মুসলিমদের অনেকে এটা বেশ গর্ব করে বলে থাকেন যে কোরআনে অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সমাহার রয়েছে যেগুলি অতিসম্প্রতি মানুষ জানতে পেরেছে। সম্প্রতি আবিষ্কৃত এসকল তথ্য ১৪০০ বছর আগের একজন সাধারণ আরবের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। অতএব..।
অবশ্যই কোরআনে মানব সৃষ্টি থেকে মহাকাশ সৃষ্টির অনেক নিদর্শনের বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এগুলি মূলত ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের আরব জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করেই অবতীর্ণ যেন তারা স্রষ্টার মাহাত্ম্য উপলিদ্ধ করতে পারেন। ২১ শতকের বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানমনষ্ক পাঠককে লক্ষ্য করে ওইসব আয়াত নাযিল করা হয়নি, এটা প্রথমেই ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার। বরং তত্কালীন আরবরা যেভাবে এবং যতটুকু বুঝতে পারবেন সেভাবেই ততটুকু যুক্তি ও তথ্য তাদের সামনে পেশ করা হয়েছে। এবং সেসব তথ্যের মাধ্যমেই তাদের বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে এক স্রষ্টার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কে। তত্কালীন আরবরা বুঝতে পারবে না বা যাচাই করতে পারবে না এরকম তথ্য বা যুক্তি তাদের সামনে পেশ করার কোন মানে হয় না। এটা ১৭:৩৬ আয়াতেরও পরিপন্থী বটে।
১৭:৩৬ যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নাই উহার অনুসরণ করিও না; কর্ণ, চক্ষু, হূদয়- উহাদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হইবে।
এটা ঠিক যে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সুবাদে কোরআনের কিছু তথ্য আমরা আরো ভালো করে বুঝতে পারছি। এটা খুবই চিত্তাকর্ষক এবং কোরআনে ঐশিগ্রন্থ হওয়ার যৌক্তিকতাও তুলে ধরে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন অষ্পষ্ট ধারণা রাখা উচিত নয় যে এসব তথ্যের প্রাথমিক উপযোগিতা ছিল তত্কালীন আরবদের সত্য উপলদ্ধি করানোর ক্ষেত্রে।
তারা বুঝতো না এমন কোন তথ্য উপস্থাপন করলে তা তাদের মধ্যে সন্দেহের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিতে এবং একই সঙ্গে অবিশ্বাস। এবং তখন কোরআনকে বানোয়াট বলে তাদের যে দাবি সেটার পালে আরো হাওয়া লাগতো।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
৫৩:৪৯ আর এই যে, তিনি শিরা (আরবী শি’রা) নক্ষত্রের মালিক।
এই নক্ষত্রের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় যে তত্কালীন আরবরা এই নক্ষত্রটির ব্যাপারে অবগত ছিল। হতে পারে, তারা এই নক্ষত্রের পূজাও করতো। এই নক্ষত্র নিয়ে গ্রীকদেরও বেশ কৌতূহল ছিল, তারা এটিকে সিরিওস বলে নামকরণ করেছিল যা রাতের আকাশে এর উল্লেখযোগ্য ঔজ্জ্যলের নিদের্শক।
এখানে কোরআনে কিন্তু বলা হয়নি যে শিরা, যাকে আমরা সিরিয়াস নামে চিনি, সেটি একটি জমজ নক্ষত্র। এই তথ্যটি বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার। কোরআনে যদি এই তথ্যটি সন্নিবেশিত থাকতো তাহলে তত্কালীন আরবরা একে মিথ্যা বলে চিহ্নিত করতো (যা আদতে সত্য)। এবং এটির সত্যতা নিরুপন করার কোন উপায় তাদের কাছে ছিল না।
একইভাকে কোরআনে বলা হয়েছে-
৫৩:৪৫ আর এই যে, তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল- পুরুষ ও নারী। শুক্রবিন্দু (আরবী নুতফাতিন) হইতে, যখন উহা স্খলিত (আরবী তুম’না) হয়।
এই আয়াতের প্রেক্ষাপটে আরবী নুতফাতিন মূলত শুক্রকেই নির্দেশ করে। মানবসৃষ্টির সূচনা যে সামান্য তুচ্ছ তরল পদার্থ থেকে সেকথা আরবরা জানতো। এটা সত্য। এখন বিজ্ঞানের অগ্রগতির সুবাদে আমরা নিশ্চিতভাবে জানছি যে, পুরুষের শুক্রই মূলত ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ করে।
এভাবে, বিজ্ঞান কোরআনে বর্ণিত তথ্যগুলোকে ব্যাখ্যা করে এবং নিশ্চিত করে। যে কথাটা মনে রাখা দরকার, কোরআনের এসব আয়াত বৈজ্ঞানিক তথ্যের নাগাল পাওয়ার জন্য এর প্রাথমিক শ্রোতাদের সামনে প্রকাশ করা হয়নি, যে বৈজ্ঞানিক তাত্পর্য তারা বুঝতে পারবে না।
একইভাবে মানব ভ্রূনের বিভিন্ন পর্যায়ের যে বর্ণনা কোরআনে আছে সে ব্যাপারে সপ্তম শতকের আরবদের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও ধারণা ছিল।
১৮:৩৭ তদুত্তরে তাহার বন্ধু তাহাকে বলিল, তুমি কি তাঁহাকে অস্বীকার করিতেছ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন মৃত্তিকা ও পরে শুক্র হইতে এবং তাহার পর পূর্ণাংগ করিয়াছেন মনুষ্য আকৃতিতে?
ফলে পর্যায়ক্রমে মানবসৃষ্টির ধারণাটি আরবদের কাছে নতুন নয়।
কোরআনে অনেক অত্যাশ্চর্য তথ্য সন্নিবেশিত আছে সাধারণভাবে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এসব আয়াতের অর্থ আরো ভালো করে বোঝা সম্ভব হচ্ছে। আগামীতে হয়তো আরো বোঝা যাবে যা এখনকার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দিয়ে আমরা বুঝতে সক্ষম নই।
মূল বিষয়টা হলো কোরআনের উপস্থাপিত চিরন্তন বক্তব্যগুলো যদি আমরা উপলদ্ধি করতে না পারি তাহলে এসব বৈজ্ঞানিক আয়াত আমাদের অহমিকাকে তুষ্ট করতে পারে কিন্তু সেটা কোন কাজের কথা নয়।