রমজান মাস কোরআনের মাসও বটে। কোরআন বিভিন্ন বিশেষণে নিজের পরিচয়টি তুলে ধরেছে। সেগুলির দিকেও মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করলে অনেক বিষয় পরিস্কার হয়।
১. পরিস্কার পথনির্দেশনা (হুদা- ক্লিয়ার গাইডেন্স)
ইহা সেই কিতাব; ইহাতে কোন সন্দেহ নাই, মুত্তাকীদের জন্য ইহা পথনির্দেশ। (২:২)
২. পরিস্কার প্রমাণ (বুরহান)
হে মানবজাতি! তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে তোমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ (বুরহান) আসিয়াছে। এবং আমি তোমাদের প্রতি স্পষ্ট জ্যোতি অবতীর্ণ করিয়াছি। (৪:১৭৪)
৩. বিস্তারিতভাবে বর্ণিত (ফুসিলাত)
এক কিতাব, বিশদভাবে বিবৃত হইয়াছে ইহার আয়াতসমুহ, আরবী ভাষায় কোরআন, যারা বোঝে তাদের জন্য। (৪১:৩)
আলিফ লাম রা। এই কিতাব প্রজ্ঞাময়, ইহার আয়াতসমুহ সর্বজ্ঞের নিকট হইতে বিশদভাবে (আরবী ফুসিলাত) বিবৃত। (১১:১)
আরবী ফুসিলাত এসেছে ফা-সাদ-লাম থেকে যার অন্তর্নিহিত অর্থ কোন কিছু স্পষ্ট হওয়া, আলাদা হওয়া, সত্য ও মিথ্যাকে প্রভেদকারী, সরল, পরিস্কার ঘোষণা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই ধাতু থেকে তৈরি শব্দ Èতাফসিল’ যার অর্থ কোন ভাষার বা বক্তব্যের বিশে্লষণ বা বিস্তারিত ব্যাখ্যা।
৪. সবকিছুর পরিস্কার ব্যাখ্যা (তিবিআনা লিকুল্লী শাইয়িন)
সেইদিন আমি উত্থিত করিব প্রত্যেক সম্প্রদায়ে তাহাদেরই মধ্য হইতে তাহাদের বিষয়ে এক একজন সাক্ষী এবং তোমাকে আমি সাক্ষীরুপে আনিব ইহাদের বিষয়ে। আমি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরুপ (তিবিয়ানা লিকুলি্ল শায়্যিন), পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদরুপে তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করিলাম। (১৬:৮৯)
লক্ষণীয়, আরবী শব্দ তিবিয়ানার এসেছে Èবা-ইয়া-নুন’ থেকে যা থেকে তৈরি হয়েছে Èবায়ান’ শব্দটি যার অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে পরিস্কার প্রমাণ, নজির বা যুক্তি।
কোরআন বোঝার ক্ষেত্রে এটি স্মর্তব্য যে, মানবজাতির Èপথনির্দেশের জন্য’ যা প্রয়োজন এমন কিছু আল্লাহ এই গ্রন্থে বাদ দেননি বা বর্ণনার ক্ষেত্রে তার শব্দের অভাব ঘটেনি।
ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল জীব এবং নিজ ডানার সাহায্যে উড়ন্ত পাখী- তাহারা সকলেই তোমাদের মতো এক একটি জাতি। কিতাবে কোন কিছুই আমি বাদ দিই নাই। অতঃপর স্বীয় প্রতিপালকের দিকে তাহাদের একত্র করা হইবে। (৬:৩৮)
পৃথিবীর সমস্ত বৃক্ষ যদি কলম হয় আর সমুদ্র হয় কালি এবং ইহার সঙ্গে আরও সাত সমুদ্র যুক্ত হয় তবুও আল্লাহর বাণী নিঃশেষ হইবে না। নিঃশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, প্রজ্ঞাময়। (৩১:২৭)
উপরের এই আয়াতটি দিয়ে এটা পরিস্কার যে, কোন বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু যদি বলতেই হতো তাহলে সেটা আল্লাহ কোরআনেই বিবৃত করতেন, তার শব্দের অভাব ঘটতো না। ইসলামের দীনের/সিস্টেমের জন্য দরকারি কোন কিছুই তিনি এই বইয়ে বাদ দেননি। সোজা কথায়, এর সঙ্গে অতিরিক্ত আর কিছু যোগ করার নেই। এই বইয়ে যা নেই সেখানে মানুষের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু স্বেচ্ছাচার নেই। কোরআনের মূলনীতির আলোকে সমকালের সমস্যাটি সে সমাধান করে নেবে তার যুক্তি-বিবেক দিয়ে।
৫. চূড়ান্ত তুলাদন্ড (মিজান)
আল্লাহই অবতীর্ণ করিয়াছেন সত্যসহ কিতাব ও তুলাদন্ড (মিজান)। আর কিভাবে তুমি উপলদ্ধি করিবে যে, কিয়ামত সম্ভবত আসন্ন। (৪২:১৭)
নিশ্চয়ই আমি রাসুলগণকে প্রেরণ করিয়াছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাহাদের সঙ্গে দিয়াছি কিতাব ও ন্যায়নীতি যাহাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। (৫৭:২৫ অংশ)
৬. সত্য ও মিথ্যার প্রভেদকারী (ফুরকান)
কত মহান তিনি যিনি তাহার বান্দার প্রতি ভাল-মন্দের নির্ণায়ক (আরবী ফুরকান) অবতীর্ণ করিয়াছেন যাহাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হইতে পারে। (২৫:১)
আরবী ফুরকান এসেছে ফা-রা-ক্বাফ থেকে যার অর্থ পার্থক্য, বিভাজন, সদ্ধিান্ত ইত্যাদি। ফুরকান হলো ভাল ও মন্দের পার্থক্যকারী।
মুসা (সাঃ) এর প্রতি অবতীর্ণ কিতাব প্রসঙ্গেও এই বিশেষণটি ব্যবহূত হয়েছে।
আর যখন আমি মুসাকে কিতাব ও ফুরকান দান করিয়াছিলাম যাহাতে তোমরা হেদায়েতপ্রাপ্ত হও। (২:৫৩)
৭. চূড়ান্ত প্রমাণ (বায়্যিনা)
উহারা বলে, “ সে আমাদের প্রতিপালকের কাছ হইতে আমাদের নিকটে কোন নিদর্শন আনয়ন করে না কেন? উহাদের নিকট কি আসে নাই সুষ্পষ্ট প্রমাণ (বায়্যিনাতু) যাহা আছে পূর্ববর্তী গ্রন্থে। (২০:১৩৩)
কিংবা তোমরা বল, Èযদি কিতাব আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হইত তবে আমরা তো তাহাদের অপেক্ষা অধিক হেদায়াতপ্রাপ্ত হইতাম।’ এখন তো তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হইতে স্পষ্ট প্রমাণ (আরবী বায়্যিনাতুন), হিদায়াত ও রহমত আসিয়াছে। অতঃপর যে কেহ আল্লাহর নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করিবে এবং উহা হইতে মুখ ফিরাইয়া নিবে তাহার চেয়ে বড় জালিম আর কে আছে? যাহারা আমার নিদর্শনসমুহ হইতে মুখ ফিরাইয়া নেয় সত্যবিমুখিতার জন্য, আমি তাহাদের নিকৃষ্ট শাসি্ত দিব। (৬:১৫৭)
কোরআন নিজেকে যেভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তাতে এটা বোঝার অবকাশ থাকে না যে, দ্বীনকে বোঝার জন্য কোরআনের বাইরে সহযোগী আর কোন সূত্র থেকে আমাদের দিকনিদের্শনার দরকার আছে।
Èএক কল্যানময় কিতাব, ইহা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করিয়াছি, যাহাতে মানুষ ইহার আয়াতসমুহ অনুধাবন করে এবং বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ।’ (৩৮:২৯)