কবর আযাবের কথা না শুনে বড়ো হয়েছে এমন একজন মুসলিমও পাওয়া যাবে কী না সন্দেহ। হাদিস ও অন্যান্য সেকেন্ডারি সোর্সের বরাতে বিস্তর প্রচারণার ফলে মুসলিমমানসে কবর আযাবের ধারণাটি আসন গেড়েই বসেছে। কোরআনে একাধিকবার কবরের উল্লেখ রয়েছে (৯:৮৪, ২২:৭, ৩৫:২২, ৬০:১৩, ৮২:৪, ১০০:৯)। কোথাও কবর আযাবের কথা নেই। কোরআন-হাদিসের আলোচনা বাদ দিলেও সাধারণ যুক্তিবুদ্ধিতেও এই ধারণাটি টেকসই মনে হয় না।
প্রথমত, মৃত্যুর পর সব মানুষেরই কবর হয় না। কারো দাহ হয়, কেউ মহাশুন্যে দুর্ঘটনায় ছাই হয়ে যায়, কেউ পানিতে ডুবে তলিয়ে যায় নদীতে, সাগরের গভীরে, এভারেস্টে চড়তে গিয়ে হিমশীতল বরফেও দেহাবসান হয় কারো কারো। যাদের কবরই হয়না তাদের ক্ষেত্রে কবর আযাবের বিধান কী?
দ্বিতীয়ত, একই পরিমাণ অন্যায় করে যে ৫ হাজার বছর আগে মারা গেছে তার কবর আযাব আর বিশ্ব ধ্বংসের ৫ ঘন্টা আগে যে মারা যাবে তার কবর আযাব তো সমপরিমাণ হবে না। স্রেফ আগে জন্মানোর জন্য একই অপরাধে কেউ বেশি শাস্তি ভোগ করবে, এটা কেমন কথা?
তারও আগের প্রশ্ন, মানুষ মারা যাওয়ার পর কিয়ামতের দিন তার পুনর্জাগরণ হবে এরকমটাই জানি। কবরে যে আরেক দফা পুনর্জন্ম হবে, কোরআনে এরকম একটা গুরুতর ঘটনার উল্লেখমাত্র নেই কেন? শেষ বিচারের দিনে যেহেতু সবারই বিচার হবে সেক্ষেত্রে আগেই কবরে শাস্তি দেওয়ার মানে কি? পরম করুণাময় তার বান্দাকে এই ডাবল পানিশমেন্ট কেন কী উদ্দেশ্যে দেবেন? এটা কি তার সুবিচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? কবরেই যদি দোষী/নির্দোষ বিচার করে শাস্তি হয়ে যায় তাহলে আবার বিচার দিবসে দোষী নির্দোষ নির্ধারণেরই বা দরকার কি? আল্লাহ বহুবার কোরআনে বলেছেন, তিনি তারা বান্দাদের উপর এক কণা পরিমান অবিচারও চাপিয়ে দেবেন না। তাহলে?
ধারণা করা যায়, অধৈর্য মানবকুল অবিশ্বাসীদের শাস্তির জন্য কেয়ামত তক অপেক্ষা করতে পারছিল না। ফলে আগেই একটা শাস্তির ব্যবস্থা হিসেবে কবর আযাবের বিষয়টি তারা আবিস্কার করে।
২.
কোরআনের আলোকে কবর আযাবের ধারণাটা যাচাই করে দেখা যাক।
কোরআনের বর্ণনা মোতাবেক, মৃত্যুর মুহূর্তে সকলের কাছেই সত্য উন্মোচিত হয়, অব্যবহিত পরেই তার আত্মা চলে যায় বারযাখ এর নিদ্রিত অবস্থায় যেখানে সময় বলে কিছু নেই। এই আত্মা পুনর্জাগরিত হবে বিচার দিবসে। জেগে ওঠার পর মাঝের সময়টাকে তার মনে হবে দিনের কিছু অংশ, যদিও ইতোমধ্যে শত সহস্র বছরও অতিক্রান্ত হয়।
১৭:৫২ যেদিন তিনি তোমাদেরকে আহ্বান করিবেন এবং তোমরা তাঁহার প্রশংসার সঙ্গে তাঁহার আহ্বানে সাড়া দিবে এবং তোমরা মনে করিবে, তোমরা অল্পকালই অবস্থান করিয়াছিলে।
৩০:৫৫-৫৬ যেদিন কিয়ামত হইবে সেদিন অপরাধীরা শপথ করিয়া বলিবে যে, তাহারা মুহূর্তকালের বেশি অবস্থান করে নাই। এইভাবেই তারা সত্যভ্রষ্ট হইত। কিন্তু যাহাদেরকে জ্ঞান ও ঈমান দেওয়া হইয়াছে তাহারা বলিবে, তোমরা তো আল্লাহর বিধানে পনুরত্থান দিবস পর্যন্ত অবস্থান করিয়াছ। ইহাই তো পনরুত্থান দিবস, কিন্তু তোমরা জানিতে না।
১০:৪৫ যেদিন তিনি উহাদেরকে একত্রিত করিবেন সেদিন উহাদের মনে হইবে, উহাদের অবস্থিতি দিবসের মুহূর্তকাল মাত্র ছিল; উহারা পরস্পরকে চিনিবে। আল্লাহর সাক্ষাত্ যাহারা অস্বীকার করিয়াছে তাহারা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে এবং তাহারা সত্পথপ্রাপ্ত ছিল না।
৪৬:৩৫ … উহাদেরকে যেই বিষয়ে সতর্ক করা হইয়াছে তাহা যেই দিন উহারা প্রত্যক্ষ করিবে, সেই দিন উহাদের মনে হইবে, উহারা যেন দিবসের এক দন্ডেরও বেশি পৃথিবীতে অবস্থান করে নাই।…
৭৯:৪৬ যেই দিন উহারা ইহা প্রত্যক্ষ করিবে সেই দিন উহাদের মনে হইবে যেন উহারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাত অবস্থান করিয়াছে।
এসব আয়াতের কোথাও কবরের উল্লেখ নেই। আরো অনেক আয়াতে সময় সংক্রান্ত এরকম ধারণার কথা ব্যক্ত হয়েছে। (১৮:১৯, ২:২৫৯) উপরের আয়াতগুলো থেকে এটা পরিস্কার, মৃত্যু ও পুনর্জাগরণের মাঝখানের সময়টা চোখের পলকের মতো। (১৬:৭৭) এবং কেউ মারা গেলে সে তত্ক্ষণাতই চলে যায় বারযাখে, যেখানে সময় স্থির।
২৩:৯৯-১০০ যখন উহাদের কাহারও মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন সে বলে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে পুনরায় প্রেরণ কর, যাহাতে আমি সত্কর্ম করিতে পারি যাহা আমি পূর্বে করি নাই। ইহা তো উহার একটি কথিত উক্তি মাত্র। উহাদের সম্মুখে বারযাখ থাকিবে উত্থান দিবস পর্যন্ত।
২৫:৫৩ ও ৫৫:২০ আয়াতেও বারযাখ টার্মটি ব্যবহার করা হয়েছে। একইভাবে বারযাখ মৃত্যু ও পুনর্জাগরণের মাঝে একটি অদৃশ্য দেয়াল (ব্যারিয়ার) হিসেবে থাকবে।
মৃত্যুর ফেরেশতা আসার যে চিত্র কোরআনে আছে সেটাকে একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে দেখা যাবে এটি কবরের কোন ঘটনা নয়। ফেরেশতা যখন আসে তখনো ব্যক্তি জীবিত। মৃত্যুর মুহুর্তে প্রত্যেক আত্মা জেনে যাবে তার পরিণতি। বিচার হবে পূনর্জাগরণের পর।
৬:৯৩ যদি তুমি দেখিতে পাইতে যখন জালিমরা মৃত্যুযন্ত্রণায় রহিবে এবং ফেরেশতাগণ হাত বাড়াইয়া বলিবে, তোমাদের প্রাণ বাহির কর! তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে অন্যায় বলিতে ও তাহার বিধান সম্বন্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করিতে, সেজন্য আজ তোমাদের অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হইবে।
৪৭:২৭ ফিরিশতারা যখন উহাদের মুখমন্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করিতে করিতে প্রাণ হরণ করিবে, তখন উহাদের দশা কেমন হইবে।
৮:৫০ তুমি যদি দেখিতে পাইতে ফিরিশতাগণ কাফিরদের মুখমন্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করিয়া তাহাদের প্রাণ হরণ করিতেছে এবং (বলিতেছে) তোমরা দহনযন্ত্রণা ভোগ কর।
৮:৫১ ইহা তাহা তোমাদের হস্ত যাহা পূর্বে প্রেরণ করিয়াছিল (বিমা কাদ্দামাত আইদিকুম), আল্লাহ তো তাহার বান্দাদের প্রতি অত্যাচারী নন।
৮:৫০ আয়াতের ‘ওয়া’ লক্ষনীয়। ৮:৫১ পরিস্কার করছে যে, দহণযন্ত্রণা শেষ বিচারের পরের বিষয়। একই সঙ্গে ফেরেশতাদের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে আরবী ইয়াওম শব্দ এবং মৃত্যু ও জেগে ওঠার অন্তবর্তীকাল (চোখের পলকের মতো) বিবেচনায় রাখলে ৬:৯৩ আয়াতের ‘আজ’ শব্দের অর্থ বুঝতে সুবিধা হবে।
৩.
কবর আযাবের প্রসঙ্গে কখনো কখনো ভুলভাবে কোরআনের আয়াতেরও উল্লেখ করা হয়। এটি করা হয় প্রধানত ফেরাউনের প্রসঙ্গে।
৪০:৪৬ উহাদেরকে উপস্থিত করা হয় আগুনের সম্মুখে সকাল ও সন্ধ্যায় এবং যেদিন কিয়ামত ঘটিবে সেদিন বলা হইবে, ফিরআওন সম্প্রদায়কে নিক্ষেপ কর কঠিন শাস্তিতে।
যদি এর পরের আয়াতের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া হয় তাহলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় যে, উপরের আয়াতের বিষয়টি বিচার দিবসের সঙ্গে সম্পর্কিত। (কিছু অনুবাদে যদিও বাক্যটির প্রথমাংশ বর্তমানকাল সূচক করা হয়েছে, কিন্তু প্রেক্ষাপট ও ক্রিয়াপদের বিবেচনায় একে ভবিষ্যৎবাচক বলে বিবেচনা করাই সঙ্গত। ইউসুফ আলী, শাকিরসহ অনেকেই এভাবেই আয়াতটির অনুবাদ করেছেন। তাছাড়া লক্ষনীয় এখানে ফিরাউনের একার কথা বলা হয়নি, বরং বহুবচনাত্মক (ইউরাদুনা) ব্যবহার করা হয়েছে।)
৪০:৪৭ যখন উহারা জাহান্নামে পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হইবে তখন দুর্বলেরা দাম্ভিকদেরকে বলিবে, আমরা তো তোমাদেরই অনুসারী ছিলাম। এখন কি তোমরা আমাদের হইতে জাহান্নামের আগুনের কিয়দংশ নিবারণ করিবে?
ফলে ৪০:৪৬ আয়াতে যে কবর আযাবের কথা বলা হয়েছে সেটা মেনে নেওয়া মুশকিল। ফারাওয়ের লোকদের পারস্পরিক দোষারোপ ও বিবাদের ঘটনা থেকে এটা পরিস্কার যে এটি সম্মিলিত শাস্তির একটা পর্যায়। আলাদা আলাদা কবরে শাস্তির ঘটনা নয়। ঠিক পরের আয়াতটি বিষয়টি আরো পরিস্কার করে।
৪০:৪৮ দাম্ভিকেরা বলিবে, আমরা সকলে তো জাহান্নামেই আছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের বিচার তো করিয়া ফেলিয়াছেন।
এখানে যে বিচারের কথা বলা হয়েছে তা শেষ বিচার দিবসের, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই। তাছাড়াও, কবর আযাব প্রসঙ্গে ফেরাউনের উদাহরণের একটা মস্ত র্ফাঁক এই যে, ফেরআউন পানিতে ডুবে মারা যান এবং তার দেহ সংরক্ষন করা হয়েছে (১০:৯২), তাঁর কোন কবর নেই। ফলে তার কবর আযাবের প্রসঙ্গই আসে না।
৪০:৪৬ আয়াতের সকাল ও সন্ধ্যার প্রসঙ্গ তুলে এটিকে দুনিয়ার ঘটনা বলে প্রমাণ করতে চান অনেকে। আদতে এটি একটি বাগধারা, এবং এরকম বাগধারা কোরআনে বহুল ব্যবহূত। যেমন ৬:৫২, ১৮:২৮, ২৫:৫ , ১৩:১৫, ২৪:৩৬, ১৯:২৬ ইত্যাদি আয়াতের কথা বলা যায়।
৬:৫২ যাহারা তাহাদের প্রতিপালককে প্রাতে ও সন্ধ্যায় তাঁহার সন্তুষ্টি লাভার্থে ডাকে তাহাদেরকে তুমি বিতাড়িত করিও না।
এর মানে তো এই না যে বিকালে বা অন্য সময় আল্লাহকে স্মরণ করে না বা করা যাবে না। এটা শুধুমাত্র নিয়মিত ও ধারাবাহিক চর্চার কথা বোঝাচ্ছে। এরকম বাগধারা অন্য ভাষাতেও বিদ্যমান।
মোদ্দাকথা
কোরআনের আলোকে কবর আযাবের ধারণাটিকে অসার মনে হয়। কবর শব্দটি বহুবার কোরআনে ব্যবহূত হলেও কোথাও একবারের জন্যও কবর আযাবের মতো গুরুতর ঘটনার উল্লেখ করা হয়নি। কোরআনে মানুষের ২টি জন্মের উল্লেখ আছে (৪০:১১)। কবর আযাব বিবেচনায় নিলে জন্মের সংখ্যা দাড়ায় তিন।