ইসলামি নাম কিংবা মুসলিম নাম

কোনো মুসলিম পরিবারে সন্তান ভূমিষ্ট হলে তার নামকরণের বিষয়টা চলে আসে। অনেকে আগে থেকেই নাম ঠিক করে রাখেন। কেউ পরে ভেবেচিন্তে নাম রাখেন। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ময়মুরুব্বির পরামর্শ থাকে, নামটা যেন ইসলামি বা মুসলিম নাম হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের কেউ এটা অনুধাবন করেন না যে, নামের কোন মুসলিম-অমুসলিম হয় না। এটা একটা ভুল ধারণা। নাম নামই। সেক্সপিয়র যেমনটা বলেছেন, ‘গোলাপ যে নামে ডাকো গন্ধ বিতরে’।

তবে হ্যা, নামের ভালো বা খারাপ অর্থ হতে পারে। সব অভিভাবকেরই লক্ষ্য থাকা সংগত যে, তার সন্তানের নামের অর্থ যেন সুন্দর হয়। নামের নিজস্ব কোন গুণ নেই। মুসলিম বিষয়টা একজন বিশ্বাসীর বৈশিষ্টসূচক। নামটা রাশান হলেও সে যদি বিশ্বাসে মুসলিম হয় তাহলে সে মুসলিম। নাম আরবী হলেও, যেমন এন্তার রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে, যদি বিশ্বাসে সে ইহুদী হয় তাহলে সে ইহুদী। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডার সুযোগ নেই।

অত্র অঞ্চলে মুসলিমদের মধ্যে আরবী নাম রাখার ব্যপক প্রচলন রয়েছে এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে যে, আরবী নাম মানেই মুসলিম নাম। এবং বিশেষ করে নবীদের বা সাহাবী বা পীর আওলিয়াদের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখার রেওয়াজ বহু পুরোনো। এটা প্রশংসনীয় বা দোষনীয় নয়। নাম তো যার যার পছন্দের বিষয়। তবে নিজ ভাষা-ঐতিহ্যের কাছে দায়বদ্ধতা অনুভব করলে সে মোতাবেক নামকরণই শ্রেয় বলে মনে হয়।

আরবী নাম মাত্রই যে মুসলিম নাম নয় এটা বোঝা যেমন জরুরী তেমনি জানা থাকা দরকার যে, সব আরবী নামই সুন্দর অর্থ বহন করে না। যেমন বঙ্গদেশে আব্বাস নামটি বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে নবীজী (সাঃ) এর চাচার নাম হওয়ার কারণে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। জনপ্রিয় ধারণায় এর অর্থ হলো সিংহ। কেউ কেউ বলেন, সিংহের চরিত্র। কিন্তু আব্বাস শব্দের সত্যিকার অর্থ এর কোনটাই নয়।

আব্বাস শব্দের শব্দমূল আবাসার ব্যবহার কোরআন শরিফেই সহজলভ্য। সুরা আবাসার প্রথম দুটি আয়াতেই সেটি বিধৃত আছে। একজন অন্ধ লোক নবীর কাছে এসেছিলেন, নবীজী তার প্রতি যে উপেক্ষা বা বিরক্তি প্রদর্শন করেছিলেন সেটাকেই আবাসা শব্দে তুলে ধরা হয়েছে। তার এই আচরণের জন্য নবীজী (সাঃ) আল্লাহ কর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছেন (৮০:১-১১)।

৮০:১-২ সে ভ্রূকুঞ্চিত করিল (আরবী আবাসা) এবং মুখ ফিরাইয়া লইল, কারণ তাহার নিকট অন্ধ লোকটি আসিল।

কোরআন থেকে আরও দুটি উদাহরণ দেয়া যাক-

৭৪:২২ অতঃপর সে ভ্রুকুঞ্চিত করিল (আরবী আবাসা) ও মুখ বিকৃত করিল।
৭৬:১০ আমরা আশংকা করি আমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে এক ভীতিপ্রদ ভয়ংকর (আরবী আবাসুন) দিনের।

শব্দটির বুত্পত্তিগত অর্থ চিরায়ত আরবী অভিধানগুলোতেও মিলবে। সেখানে কোথাও একে সিংহ বা সিংহের সাহসিকতা বা সিংহহূদয়ের সমার্থক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। বরং সিংহের যে কঠোরতা, আগ্রাসী মনোভাব সেটাকেই তুলে ধরেছে। এডোয়ার্ড লেনের লেক্সিকনে শব্দটির যেসব অর্থ দেওয়া আছে তা হলো – হি ফ্রাউন্ড (লুকড স্টার্নলি) অর কন্ট্রাকটেড হিজ ফেস, হি গ্রিনড অর ডিসপ্লেড হিজ টিথ। …আব্বাসুন সিগনিফাই এ ম্যান হ্যাভিং এ হেইটফুল ফেস। … হেন্স আবিসু সিগনিফাইস দি লায়ন …অর দি লায়ন ফ্রম হুম আদার লায়নস ফ্লি (দেখুন এডোয়ার্ড লেনের লেক্সিকন ভলিউম ৫ পৃষ্ঠা ১৯৩৯)।

আবার এটাও বোঝার বিষয়, অনেক নবীর নামে যে নামগুলো রাখা হয় সেগুলো তাদের আসল নাম নয় বরং তত্কালীন আরবরা তাদেরকে যে নামে চিনতো সেটাই কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন প্রথম শতকের প্যালেস্টাইনবাসী কিংবা তার মায়ের কাছে ঈসা (সাঃ) খুব সম্ভব ইয়েসুহা (হিব্রু) বা জেসুহা (আরামিক) নামেই পরিচিত ছিলেন। ইসা নামে তার মা তাকে চিনতেন না। কিন্তু সপ্তম শতকের আরবদের কাছে তিনি ঈসা (সাঃ) নামে পরিচিত ছিলেন বিধায় তাকে এই নামেই কোরআনের শ্রোতাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে।

নামগুলির মধ্যে ধ্বনিগত সাযুজ্য এসেছে আরব ইহুদী ও খৃস্টানদের সুবাদে। যেমন মেরি থেকে মরিয়ম ইত্যাদি। সেমেটিক ভাষাগুলির মধ্যে এরকম সাযুজ্য সহজলভ্য।

একইভাবে মুসা (সাঃ) ফিরাউন বা তার জনপদবাসীর কাছে খুব সম্ভব মোশে (মোজেস) নামে পরিচিত ছিলেন। ফেরাউনের পরিবারই হয়তো তার এ নামকরণ করে। তবে তার গর্ভধারিনী মা-ই তার এ হিব্রু নাম রাখার ব্যাপারে ফেরাউনের কন্যা বিথিয়াকে রাজী করিয়েছিলেন, এরকমও মত আছে। হিব্রুতে মোশের অর্থও পানি থেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিধায় বিথিয়া এ নিয়ে আপত্তি করেননি। আবার ইবনে এজরা বলেন, বিথিয়া মিশরীয় নাম মুনিয়াস রেখেছিলেন তোরাহতে যার হিব্রু অনুবাদ করা হয়েছে মোশে (মোজেস)। এজরার ধারনা বিথিয়া হিব্রু জানতেন, তিনিই মোজেসের হিব্রু নামকরণও করেন।

কোরআনে নবীজীর সমসাময়িক দুজনের নামই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত মোহাম্মদ (সাঃ) এবং তার পালকপুত্র যায়িদ (৩৩:৩৭)। দ্বিতীয়ত আবু লাহাব। এ নাম নিয়ে বিতর্ক আছে যে, এটি কোন ব্যক্তিনাম নাকি কোন উপনাম যা কোন উগ্র মেজাজের ব্যক্তিকে নির্দেশ করে (আগুনের পিতা)।

আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। নবী বা তার সাহাবীদের যেসব নাম আমরা জানি তার সবই কিন্তু পৌত্তলিক সময়ে রাখা। যেমন আবু বকর অনেক বকরী বা গবাদি পশুর মালিক ছিলেন বিধায় এই উপনামে পরিচিত ছিলেন। এর অর্থ গরুর পিতা। ইসলাম গ্রহণের পরও তিনি এই নাম বদল করেননি। নামের ইসলামিকরণ জরুরী হলে নিশ্চয়ই এর চেয়ে সুন্দর কোন নাম তিনি বা অন্যান্য সাহাবীরা বেছে নিতেন। নবীর ঘনিষ্ট সহচররা নিশ্চিতভাবেই জানতেন, নাম নয়, মুসলিমের পরিচয় তার কর্মে।

নামে যে কিছু আসে যায় না একথা কোরআনে আল্লাহ তার নিজের নাম প্রসঙ্গেও বলেছেন। তিনি তার বান্দাদের বলেছেন যে কোন সুন্দর নামে তাকে ডাকতে।

১৭:১১০ বল, তোমরা আল্লাহ নামে আহ্বান কর বা রাহমান নামে আহ্বান কর, তোমরা যে নামেই আহ্বান কর সকল সুন্দর নাম তো তাঁহার।

৭:১৮০ আল্লাহর জন্য রহিয়াছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাঁহাকে সেই সকল নামেই ডাকিবে; যাহারা তাঁহার নাম বিকৃত করে তাহাদিগকে বর্জন করিবে; তাহাদের কৃতকর্মের ফল তাহাদিগকে দেওয়া হইবে।

৫৯:২৪ তিনিই আল্লাহ সৃজনকর্তা, উদ্ভাবন কর্তা, রূপদাতা, তাঁহারই সকল উত্তম নাম।

এবং সুন্দর নাম শুধুমাত্র আরবী ভাষা থেকেই নিতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। সকল উত্তম নাম, তা সে যে ভাষারই হোক, কবুল হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top