ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কতটা নির্ভরযোগ্য?

Close-up of an open religious book with a red ribbon, offering a soft, contemplative atmosphere.

সম্প্রতি সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। এর আগে ১৯৮৭ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বইটি প্রকাশ করলেও সেটি এখন আউট অফ প্রিন্ট। ফলে এই বইটি একটা অভাব পূরণ করল বটে। ইসলামি সাহিত্যকর্ম হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা, সন্দেহ নেই। কিন্তু নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসেবে একে কবুল করা কষ্টকর। বিষয়টি শুরুতেই পাঠক বুঝে নিতে পারতেন যদি এ গ্রন্থে মূল বইয়ের ভূমিকাটি যুক্ত থাকতো। আলফ্রেড গিয়মের যে ইংরেজি বইটি থেকে অনুবাদকর্মটি প্রকাশ করা হলো তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি বাংলা অনুবাদে বাদ দেওয়া হয়েছে।আগ্রহী পাঠক সহজেই অনলাইন থেকে বইটি নামিয়ে ভূমিকাটি পড়ে নিতে পারবেন। বইয়ের শেষে যুক্ত ইবনে হিশামের নোটস অংশটিও গুরুত্বপূর্ণ। (https://www.thereligionofpeace.com/…/Guillaume–Life… )

নবীজী (সাঃ) এর প্রথম জীবনীকার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন ইবনে ইসহাক (জন্ম ৭০৪ খৃষ্টাব্দ )। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই দুনিয়ায় ইবনে ইসহাক রচিত/লিখিত কোন বইয়ের কপি নেই। মূলত তাঁর ছাত্ররা এই বইয়ের তথ্য অন্যদের কাছে ট্রান্সমিট করেন যারা পরবর্তীতে সেইসব তথ্যকে সম্পাদনা/সংশোধন করে প্রকাশ করেছিলেন। ট্রান্সমিটারদের মধ্যে কম বেশি ১৫ জনের নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে ট্রান্সমিশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাটি হলো ইবনে ইসহাক-আল বাক্কাই-ইবনে হিশাম। আল বাক্কাই সম্পর্কে আমরা খুব সামান্যই জানি। আল বাক্কাই এর কাছ থেকে ইবনে হিশাম ইবনে ইসহাকের বইয়ের যেটুকু পেয়েছিলেন সেটাই সংশোধন ও সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। গিয়মের বইটি মূলত এই বইয়ের উপর নির্ভর করেই রচিত হয়েছে । ইবনে হিশাম বইয়ের নোটস সেকশনে (অক্সফোর্ড প্রকাশিত গিয়ামের বইয়ের পৃষ্ঠা ৬৯১) খুব স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন যে, ইবনে ইসহাকের অনেক তথ্য বিভ্রান্তিকর, প্রামাণিক নয় বলে তিনি সেগুলি বাদ দিয়েছেন।

“…and omitting some of the things that I.I (Ibn Ishaq) has recorded in this book in which there is no mention of the apostle and about which the Quran says nothing and which are not relevant to anything in this book or an explanation of it or evidence for it; poems which he quotes that no authority on poetry whom I have met knows of; things which it is disgraceful to discuss; matters which would distress certain people; and such reports as al-Bakka’i told me he could not accept as trustworthy – all these things I have omitted”

ইবনে ইসহাক মুলত তৎকালে প্রচলিত বিবিধ মাগাজির (মূলত নবীজী যেসব সামরিক অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন সেগুলির বিবরণ ইত্যাদি) উপর ভিত্তি করেই নবীজীবনী দাড় করিয়েছিলেন। তখনকার দিনে হাদিস বলায় অনেকে যতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করতো মাগাজির বেলায় ঠিক ততটা ভ্রুক্ষেপ করতো না। কারো কাছে শোনা গল্প অন্যের কাছে অক্লেশে পাস করে দিতো অনেকেই কোনরকম বাছবিচার না করেই। ওয়াহবের (ওয়াহব বিন মুনাব্বিহ) প্যাপিরাস পাঠ করলেই বোধগম্য হয় যে ইবনে ইসহাকের সিরাতের মধ্যে কিভাবে পৌরাণিক বর্ণনার মিশেল যুক্ত হয়েছে। (Kister, The Sîrah Literature, 357.) তৎকালে মাগাজি নিয়ে জনমনেও দ্বিধা ছিল ,এটা স্পষ্ট। আল জুহরির বর্ণনা মোতাবেক, খলিফা আবদুল মালিক এরকম একটি মাগাজি বই তার এক ছেলের হাতে দেখে সেটি নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন এবং তার ছেলেকে কোরান পড়া ও সুন্নার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। (Ignaz Goldziher, Muslim Studies, trans. by C. R. Barber and S: M. Stem (London: Allen and Unwin, 1971), 2: 191. )

ইবনে ইসহাক তার বইটি লেখা শেষ করেছিলেন নবীজী (সাঃ) মারা যাওয়ার ১৩০ বছর পর, ৭৬০ থেকে৭৬৩ সালের মধ্যে কোন এক সময়। আব্বাসিয় খলিফা আল মনসুরের জন্য বইটি রচনা করেন তিনি। এই তথ্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আব্বাসীয়দের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মোটিভ ছিল।

ইবনে ইসহাকের বইয়ে অন্যতম ক্রটি হলো এতে বিস্তর বেনামী সূত্রের উল্লেখ। এসব সূত্র প্রসঙ্গে লেখক শুধু লিখেছেন, ‘তিনি এমন একজন যার ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নাই’ বা ‘একে সন্দেহ করার কোন কারণ নাই’। থার্ড পারসন রেফারেন্স, কখনো কখনো কোন নামই উল্লেখ না করা, সরাসরি বর্ণনা দেওয়া, অন্যের তথ্য কোন ভেরিফিকিশেন না করেই চালিয়ে দেওয়া, সোর্সের নাম গোপন করা ইত্যাদি এ বইয়ের ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। (যেমন: শবে মেরাজ ও নবীর স্বর্গারোহনের বিষয়ে ইবনে ইসহাক কিভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছেন গিয়ামের বইয়ের ১৮১-১৮৫ পৃষ্ঠায় তার নমুনা ছড়িয়ে আছে।) এছাড়াও মাঝে মধ্যেই তিনি একটি ঘটনা উল্লেখ করে শেষে বলেছেন,‘আল্লাহই ভালো জানেন। হে আল্লাহ নবী যা বলেননি তা বলার থেকে আপনি আমাকে রক্ষা করুন।’

ইবনে ইসহাকের বইয়ে যেসব কবিতা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলির সত্যতা নিয়ে ইবনে হিশাম গভীর সন্দেহ পোষণ করেছেন। ইবনে আল নাদিম ইবনে ইসহাককে জালিয়াতির মাস্টার বলে উল্লেখ করেন। কবিতা নিয়ে জালিয়াতির কাজ সেকালে হরহামেশাই হতো। নবীর কবি বলে পরিচিত হাসান বিন সাবিতও তার নামে চালু অনেক কবিতা শুনে যারপরনাই বিষ্মিত হতেন।

গিয়াম তাঁর ভূমিকায় ইবনে সাইদুল নাস এর ‘উইয়ুন আল আসর ফি ফুনুননিল মাগাজি ওয়াল শামালি ওয়াল সিয়ার’ (‘Uyun al-Athar fi fununi’l-maghazi wa’l-shama’ili wa’l-siyar’) বইটিকে ইবনে ইসহাক সম্পর্কে সমসাময়িক মুসলিমদের মতামতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ওই বই থেকে কিছু তথ্য উল্লেখ করেছেন তিনি। এখানে কিছু নমুনা তুলে দেওয়া হলো :

আল-দুরি বলেছেন, ইবনে ইসহাককে বিশ্বাস করা যায় তবে ফিকহের প্রসঙ্গ এলে মালিক বা অন্যদের মতো তার বক্তব্যকে গুরুত্ব দেয়া চলে না। আল-নাসাই বলেছেন, তাঁর বর্ণনা খুব পোক্ত নয়। ইবনে ইসহাক তার বাবার বরাতে যেসব কথা বলেছেন সেগুলির কোন প্রমাণ নেই বলে জানিয়েছেন আল দারাকুতনি। ইয়াহিয়া বিন সাইদ বলেছেন যে তিনি কুফায় থাকতেই ইবনে ইসহাককে চিনতেন। তিনি তার কোন বক্তব্যকে চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করেননি। মালিক বিন আনাস তাকে অ্যান্টিক্রাইস্ট বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনে ইসহাক ইহুদী ও খ্রিস্টানদের দেওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করতেন- এরকম অভিযোগ রয়েছে।

হিশাম বিন উরওয়াকে একবার বলা হয় যে ইবনে ইসহাক তো ফাতিমার বরাতে একটা বর্ণনা দিয়েছে। হিশাম তখন বলেন, রাস্কেলটা মিথ্যা কথা বলে। সে আমার স্ত্রীর সাথে দেখা করল কখন?

ইবনে ইসহাক প্রসঙ্গে ইবনে ইদ্রিসকে মালিক বলেন, ওকে তো আমরা মদিনা থেকে খেদিয়ে দিয়েছি। আবু দাউদ বলেছেন যে তিনি আহমদ ইবনে হাম্বলের কাছে শুনেছেন, ইবনে ইসহাক অন্য মানুষের কথা নিজের নামে চালিয়ে দিতে ওস্তাদ। আহমদ বলেছেন, ইবনে ইসহাক মাঝে মাঝে এমনভাবে হাদিস বর্ণনা করতেন যেন তিনি কোন সাহাবীর কাছ থেকে শুনে বলছেন। মাঝের কোন রাবীর কথাই তিনি উল্লেখ করতেন না। আইনি বিষয়ে তার মতকে একেবারেই গুরুত্ব দিতেন না ইবনে মঈন। সুলায়মান আল তায়মু তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন, তার ইসনাদে বিস্তর খুঁত ছিল বলে তাকে অগ্রাহ্য করেছেন অনেকে। অনেকেই শিয়া বলে তার বক্তব্য গ্রহণ করেননি।

গিয়ম ভূমিকাতে ইবনে সাইদুল নাসের বই থেকে এরকম আরো অনেক অভিযোগের নমুনা তুলে ধরেছেন। এতকিছুর পরও নির্বিচারে সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বইটিকে পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য বলে মেনে নেওয়া খুব মুশকিল। তবে বিশ্বাসীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ না হলেও গবেষকদের হয়তো নানা কারণে এই বইটি কাজে লাগতে পারে।

Scroll to Top