‘আর রাহমান’ এর অর্থ কি পরম করুণাময়?

Ar Rahman

পরম করুণাময় ও পরম দয়ালু আল্লাহর নামে- বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এর অনুবাদ আমরা এভাবেই পড়ে অভ্যস্ত। রাহমান নামের অর্থ বাংলায় পরম করুণাময় ও ইংরেজিতে The Most Gracious, The Most Beneficent ইত্যাদি করা হয়। আরবী ভাষাভাষীরাও অর্থের দিকে দিয়ে এই অর্থকেই গ্রহণ করেন। যদিও মনে একটা খটকা লাগা স্বাভাবিক যে, করুণা ও দয়া তো প্রায় সমার্থবোধক শব্দ। পরপর একইরকম দুটি নাম বা বিশেষণ ব্যবহারের তাত্পর্য কী?

আরবী ভাষার বিচারে এর নানারকম ব্যাখ্যা আলেমরা দিয়ে থাকেন। তারা ধরেই নিয়েছেন যেহেতু একই রা হা মিম থেকে এসেছে, সুতরাং রাহমান ও রাহিম এর অর্থও সমার্থক হবে। কিন্তু কোরআনে শব্দটির ব্যবহার কীভাবে হয়েছে তা লক্ষ্য করলে ভিন্ন অর্থের কথা মনে হয়। রাহমান শব্দের অর্থ বা ব্যাখ্যা কী হবে সেটাতো আর রাহমানই ভালো জানেন, অভিধানকার বা আলেমরা নয়। কোরআনে এর ব্যবহার দেখলে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় এর অর্থ কোনক্রমেই পরম করুণাময় নয় বরং এর অর্থ হবে সর্বশক্তিমান (The All-Powerful)।

প্রথমত আল্লাহ নিজেই কোরআনে আর রাহমান নামকে আল্লাহ নামের তুল্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এবং এই নাম দুটিকে অদলবদল করে ব্যবহার করেছেন সুরা বনী ইসরাইলে। (১৭:১১০)

১৭:১১০ বল, তোমরা আল্লাহ নামে আহ্বান কর বা রাহমান নামে আহ্বান কর, তোমরা যে নামেই আহ্বান কর সকল সুন্দর নাম তো তাঁহার।

১৯ নম্বর সুরায় সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার আর রাহমান শব্দটি ব্যবহূত হয়েছে (১৬ বার)। এখানেও এর ব্যবহার লক্ষ্য করলে বোঝা যায় এর অর্থ করুণাময় নয়।

১৯:১৮ ..আমি তোমা হইতে দয়াময়ের (আর রাহমান) শরণ লইতেছি।

এখানে মরিয়াম আশ্রয় চাইছেন অনুপ্রবেশকারী কারো কাছ থেকে, তখনও তিনি জানেন না যে ইনি জিবরিল। এখানে তিনি সুরক্ষা চাচ্ছেন, দয়া বা করুনা নয় এবং সেটা চাচ্ছেন আর রাহমানের কাছে। আর রাহমান নামটি ব্যবহার করে তিনি নিশ্চয়ই অনুপ্রবেশকারীর মনেও ভয় সঞ্চার করতে চেয়েছেন। মরিয়ম নিশ্চয়ই আর রাহমানের অর্থ জানতেন।

১৯:৪৫ হে আমার পিতা! আমি তো আশংকা করি যে, তোমাকে দয়াময়ের (রাহমান) শাস্তি স্পর্শ করিবে, তখন তুমি হইয়া পড়িবে শয়তানের বন্ধু।

এখানে ইব্রাহিম (সাঃ) বলছেন তার বাবাকে, যিনি একজন অবিশ্বাসী ও মূর্তিপূজক, যে, ‘আমি ভয় করছি আর রাহমানের শাস্তি আপনার উপর আপতিত হতে পারে।’ শাস্তি দেওয়া তো পরম করুণাময়ের কাজ নয়। শুধু শাস্তি দেওয়া নয় শয়তানকে তার গাইড করে দেওয়াও হচ্ছে এখানে। এটা কি আর রাহমানের করুনার প্রকাশক? নাকি চূড়ান্ত কর্তৃত্বশীল এবং পরম শক্তিশালী শাস্তিদাতার?

১৯:৮৫-৯৬ যেদিন দয়াময়ের (আর রাহমান) নিকট মুত্তাকীদের সম্মানিত মেহমানরুপে সমবেত করিব এবং অপরাধীদেরকে তৃষ্ণাতুর অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হাঁকাইয়া লইয়া যাইব।

এই আয়াতগুলিতে বারবার আর রাহমানের নাম নেয়া হয়েছে। ভালো করে পড়লে বোঝা যাবে, এসব আয়াতে আল্লাহর সর্বশক্তিমান সত্তার কথাই বলা হয়েছে। সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা কর্তৃত্ব ইত্যাদির ্রকাশ ঘটেছে এতে।

সুরা ত্বা-হার প্রথম ৫টি আয়াত লক্ষ করলেও বোঝা যাবে বিষয়টি।

২০:১-৫ ত্বা-হা। তুমি ক্লেশ পাইবে এইজন্য আমি তোমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করি নাই, বরং যে ভয় করে কেবল তাহার উপদেশার্থে, যিনি পৃথিবী ও সমুচ্চ আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার নিকট হইতে ইহা অবতীর্ণ। দয়াময় (আর রাহমান) আরশে সমাসীন।

এখানে আর রাহমানের আরশে সমাসীন হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, যা তার কর্তৃত্ব প্রকাশেরই অভিব্যক্তি। এখানে করুনা বা দয়ার প্রসঙ্গ আসে না। আসনটা সর্বশক্তিমানের। করুণাময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

সুরা ত্বাহার ১০৮ ও ১০৯ আয়াতে শেষ বিচারের দিনের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে আর রাহমানের কর্তৃত্বের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে তার অনুমতির যে প্রসঙ্গ এসেছে তার সঙ্গেও তার অসীম কর্তৃত্ব সম্পর্কিত।

২০:১০৮-১০৯ সেই দিন উহারা আহ্বানকারীর অনুসরণ করিবে, এই ব্যাপারে এদিক-ওদিক করিতে পারিবে না। দয়াময়ের (আর রাহমান) সম্মুখে সকল শব্দ স্তব্ধ হইয়া যাইবে; সুতরাং মৃদু পদধ্বনি ব্যতীত তুমি কিছুই শুনিবে না। দয়াময় (আর রাহমান) যাহাকে অনুমতি দিবেন ও যাহার কথা তিনি পসন্দ করিবেন সে ব্যতীত কাহারও সুপারিশ সেই দিন কোন কাজে আসিবে না।

নিচের আয়াতগুলিও মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝা যাবে, রাহমানের অর্থ পরম দয়াময়/করুণাময় হিসেবে নিলে এসব আয়াতের তাত্পর্য বোধগম্য হয় না বরং সর্বশক্তিমান হিসেবে গ্রহণ করলেই আয়াতগুলির অর্থ পরিস্কার হয়।

২১:৪২ বল, রাহমান হইতে কে তোমাদেরকে রক্ষা করিবে রাত্রিতে ও দিবসে? তবুও উহারা উহাদের প্রতিপালকের স্মরণ হইতে মুখ ফিরাইয়া নেয়।

২১:১১২ রাসুল বলিয়াছিল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি ন্যায়ের সঙ্গে ফায়সালা করিয়া দিও, আমাদের প্রতিপালক তো দয়াময় (আর রাহমান) তোমরা যাহা বলিতেছ সে বিষয়ে একমাত্র সহায়স্থল তিনিই।

২৫:২৬ সেই দিন কর্তৃত্ব হইবে বস্তুত দয়াময়ের (আর রাহমান) এবং কাফিরদের জন্য সেই দিন হইবে কঠিন।

২৫:৫৯ তিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও উহাদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছু ছয় দিবসে সৃষ্টি করেন; অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনিই রাহমান, তাঁহার সম্বন্ধে যে অবগত আছে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ।

২৫:৬৩ রাহমান এর বান্দা তাহারাই যাহারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে।…

৩৬:১১ তুমি কেবল তাহাকেই সতর্ক করিতে পার যে উপদেশ মানিয়া চলে এবং না দেখিয়া দয়াময়কে (আর রাহমান) ভয় করে।

৩৬:২৩ আমি কি তাঁহার পরিবর্তে অন্য ইলাহ গ্রহণ করিব? দয়াময় (আর রাহমান) আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করিতে চাইলে উহাদের সুপারিশ আমার কোন কাজে আসিবে না এবং উহারা আমাকে উদ্ধার করিতেও পারিবে না।

৩৬:৫২ উহারা বলিবে, হায়! দুর্ভোগ আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল হইতে উঠাইল? দয়াময় (আর রাহমান) তো ইহারই প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন এবং রাসুলগণ সত্যই বলিয়াছিলেন।

৪৩:৩৬ যে ব্যক্তি দয়াময়ের (আর রাহমান) স্মরণে বিমুখ হয় আমি তাহার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান, অতঃপর সে-ই হয় তার সহচর।

৫০:৩২-৩৩ ইহারই প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেওয়া হইয়াছিল প্রত্যেক আল্লাহ অভিমুখী, হিফাজতকারীর জন্য – যাহারা না দেখিয়া দয়াময়কে (আর রাহমান) ভয় করে এবং বিনীত চিত্তে উপস্থিত হয়।

৬৭:৩ যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন স্তরে স্তরে সপ্তাকাশ। দয়াময়ের (আর রাহমান) সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত পাইবে না। তুমি আবার তাকাইয়া দেখ, কোন ক্রটি দেখিতে পাও কি?

৬৭:১৯ উহারা কি লক্ষ্য করে না উহাদের উর্ধ্বদেশে বিহঙ্গকূলের প্রতি, যাহারা পক্ষ বিস্তার করে ও সংকুচিত করে? দয়াময়ই (আর রাহমান) উহাদের স্থির রাখেন। তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক দ্রষ্টা।

৬৭:২০ দয়াময় (আর রাহমান) ব্যতীত তোমাদের এমন কোন সৈন্যবাহিনী আছে কি, যাহারা তোমাদের সাহায্য করিবে? কাফিররা তো রহিয়াছে প্রবঞ্চনার মধ্যে।

৬৭:২৮-২৯ বল, তোমরা ভাবিয়া দেখিয়াছ কি- যদি আল্লাহ আমাকে ও আমার সঙ্গীদেরকে ধ্বংস করেন অথবা আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন, তবে কাফিরদেরকে কে রক্ষা করিবে মর্মন্তুদ শাস্তি হইতে? বল, তিনিই দয়াময় (আর রাহমান) আমরা তাঁহাকে বিশ্বাস করি ও তাঁহারই উপর নির্ভর করি, শীর্ঘই তোমরা জানিতে পারিবে কে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রহিয়াছে।

৭৮:৩৭-৩৮ যিনি প্রতিপালক আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও উহাদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর, যিনি দয়াময় (আর রাহমান) ; তাঁহার নিকট আবেদন নিবেদনের শক্তি তাহাদের থাকিবে না। সেই দিন রুহ ও ফিরিশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াইবে; দয়াময় (আর রাহমান) যাহাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত অন্যেরা কথা বলিবে না এবং সে যথার্থ বলিবে।

সুরা আর রাহমানে আল্লাহ এই পৃথিবী ও পরকালের সৃষ্টি সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করেছেন। পুরো সুরা পাঠ করলে বোঝা যাবে, এই বর্ণনায় মূলত স্রষ্টা হিসেবে তার শ্রেষ্ঠত্বকেই তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর পরাক্রম, সবকিছুর উপর তার নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্বের কথাই ঘোষণা করেছেন বারবার।

কাজে কোরআনের আয়াতে আর রাহমান শব্দের ব্যবহার থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শব্দটি মূলত সর্বশক্তিমান, পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞাতা, স্রষ্টার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যিনি পরম দয়ালুও (আর রাহিম) বটে। আমরা যদি প্রথমে তার সর্বশক্তিমান সত্তাকে মেনে নিই তবেই না আমরা তাঁর করুণার প্রার্থনা করতে পারি। এই দুটি বৈশিষ্ট্য পরম শক্তিমান ও পরম দয়ালু মূলত পরস্পর বীপরিত ও পরিপূরক। আর রাহমানও ও আর রাহিম এই দুই সত্তার ক্ষমতায় ও করুণায় পরিচালিত হচ্ছে বিশ্ব।

Scroll to Top